আইডিআরএ'র প্রতিবেদন

বিমা কোম্পানিতে পলিসি তামাদির প্রবণতা বাড়ছে

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
বিমা কোম্পানিতে পলিসি তামাদির প্রবণতা বাড়ছে

বিমা কোম্পানিগুলোর পলিসি তামাদি হওয়ার প্রবণতা ক্রমেই বাড়তির দিকে। গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩৪টি বিমা কোম্পানির কাছে ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে নতুন করে তামাদি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষের বিমা। নিয়মিত প্রিমিয়াম অর্থাৎ কিস্তির টাকা পরিশোধ না করাই এর কারণ। তামাদি হয়ে কোম্পানির কাছে টাকা আটকে থাকা বিমার গ্রাহকের মধ্যে রয়েছেন গৃহকর্মী ও রিকশাচালকের মতো দরিদ্র-হতদরিদ্র মানুষও।

সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, কোম্পানিগুলোর তরফে বিমার দাবি পরিশোধে সমস্যার পাশাপাশি তামাদির ঘটনা পুরো খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিমা তামাদি হওয়ার শীর্ষে রয়েছেÑ ডেলটা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এ কোম্পানিতে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর সময়ে নতুন করে ৫৬ হাজার ৩৩৮টি বিমা তামাদি হয়েছে। ৫৬ হাজার ৯৯টি তামাদি বিমা নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্স। তৃতীয় থেকে পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স (৩৩ হাজার ৩৭৮), প্রগতি লাইফ (২৩ হাজার ২৩) ও আলফা লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেড (২১ হাজার ৯১৭)। তামাদি বা ল্যাপস বিমা পলিসি হচ্ছে এমন বিমা, যা কিস্তি (প্রিমিয়াম) পরিশোধ না করার কারণে বন্ধ হয়ে যায়। তামাদি হলে বিমার সুবিধাগুলো আর পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে বকেয়া প্রিমিয়াম ও সুদ দিয়ে পলিসি নতুন করে চালু করতে হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিমা করাতে পারলে দ্বিগুণ মুনাফার প্রলোভনে এজেন্টরা ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে অনেককে বিমা গ্রহণে রাজি করান। জীবনের অনিশ্চয়তার বিবেচনায় ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেক মানুষ নিজেদের আগ্রহেও পলিসি কেনেন। কিন্তু প্রায়ই কিছুদিন কিস্তির অর্থ পরিশোধ করার পর এজেন্টদের খুঁজে পাওয়া যায় না। কিস্তির টাকার অঙ্ক তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় কেউ কেউ মনে করেন, যা দিয়েছি তা-ই লোকসান, আর দেব না, লোকসানও বাড়াব না। এভাবেই বিমা তামাদি হয়ে যায়।

আইডিআরএর প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি ৩৪টি কোম্পানি গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে নতুন করে ৩ লাখ ৪৭ হাজার পলিসি তামাদি হয়েছে বলে ঘোষণা করেছে। এগুলোর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা করপোরেশনের রয়েছে ৪ হাজার ৮০৬টি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নতুন প্রজন্মের প্রতিষ্ঠান আলফা ইসলামী লাইফের ২১ হাজার ৯১৭টি, আস্থা লাইফের ১ হাজার ৬৯৭টি ও আকিজ তাকাফুল লাইফ ইনস্যুরেন্সের ১ হাজার ৩৪২টি বিমা তামাদি হয়েছে। তৃতীয় প্রান্তিকে পুরোনো বিমা কোম্পানির মধ্যে উল্লিখিত শীর্ষ পাঁচের বাইরে মেটলাইফের ২০ হাজার ৪০৪টি, রূপালী লাইফের ২০ হাজার ৩০টি, প্রাইম ইসলামী লাইফের ১৯ হাজার ৮৭৭টি, স্বদেশ লাইফের ১৬ হাজার ৬৮৫, মেঘনা লাইফের ৮ হাজার ১১২, বেঙ্গল ইসলামী লাইফের ৮ হাজার ৯, সানলাইফের ৭ হাজার ১৯২, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের ৫ হাজার ৬৭০, চার্টার্ড লাইফের ৫ হাজার ৪৬, গার্ডিয়ান লাইফের ৪ হাজার ৮৭৯টি, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফের ৪ হাজার ৭৫৩টি ও হোমল্যান্ডের ৪ হাজার ২৯৯ বিমা তামাদি হয়েছে। কয়েকশ থেকে ৪ হাজারের ঘর পর্যন্ত রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

আইডিআরএর প্রতিবেদন অনুসারে, এর আগে ২০২৪ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ৩২টি জীবন বিমা কোম্পানি তামাদি করেছিল ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৬২৩টি বিমা। এগুলোর মধ্যে শীর্ষে থাকা নতুন প্রজন্মের সোনালী লাইফের তামাদি বিমার সংখ্যা ৬৭ হাজার ৫৫৫। ৫৭ হাজার ৯৮১টি তামাদি বিমা নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ডেলটা লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেড। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ন্যাশনাল লাইফের তামাদি বিমার সংখ্যা ৩১ হাজার ৬৬৭।

আইডিআরএর পরিচালক ও মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তামাদির হার কমানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আইডিআরএর সরাসরি জনসচেতনতা বাড়ানোর সুযোগ নেই। শুধু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লাইসেন্সধারী এজেন্টরা বিমা করাতে পারবেন। তারাই গ্রাহকদের সচেতনতা বাড়াবেন। প্রশিক্ষিত এজেন্ট নিয়োগ না দিলে বিমা কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কাজিম উদ্দিন বলেন, এমনিতেই বিমা বিষয়টির প্রতি মানুষের কিছুটা আস্থাহীনতা রয়েছে। ব্যাংক সময় মতো টাকা দিতে না পারায় এই আস্থাহীনতা আরও বেড়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে অনেক গ্রাহকই বিমার প্রিমিয়ামের টাকা ঠিকমতো জমা দেন না। এতে অনেক পলিসি ল্যাপস (তামাদি) হয়ে যায়। তিনি বলেন, আর্থিক সংকটসহ নানা কারণে অনেকে যথাসময়ে প্রিমিয়ামের টাকা জমা দিতে না পারায় পলিসি ল্যাপস হচ্ছে। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ গ্রাহক ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্সেরই। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ল্যাপসও বেশি হতে পারে। কিস্তি জমা দেওয়ার জন্য তারা নিয়মিত গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন জানিয়ে কাজিম উদ্দিন বলেন, অনেক পলিসি গ্রহীতা তিন-চার কিস্তি একসঙ্গে জমা দিয়ে ল্যাপস পলিসি চালু করছেন। এতে ভবিষ্যতে পলিসি ল্যাপসের সংখ্যা কমে আসবে বলে তাদের প্রত্যাশা।

আইডিআরএর তথ্যমতে, জীবনবিমা কোম্পানিগুলো ২০১৮ সালে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার, ২০১৯ সালে ১৪ লাখ ৪৯ হাজার, ২০২০ সালে ১৪ লাখ ২০ হাজার, ২০২১ সালে ৯ লাখ ২৬ হাজার, ২০২২ সালে ১১ লাখ ৫৩ হাজার এবং ২০২৩ সালে ১৫ লাখ ৪২ হাজার বিমা তামাদি করেছে। এই তামাদি বিমার মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পুনরায় চালু হয়েছে। বাকি ৮৫-৯০ শতাংশ বিমার টাকা বিমা কোম্পানিগুলোর পকেটে গেছে।

বিমা খাতের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমান অবস্থা থেকে এ খাতের উত্তরণ ঘটাতে এজেন্টদের কমিশন দেওয়ার নিয়মনীতি সংশোধন করতে হবে। কোম্পানিগুলোকে বিমার দাবি পরিশোধে আরও সক্রিয় হতে হবে। বিমার প্রিমিয়ামের টাকা সশরীর পরিশোধের পাশাপাশি অনলাইনে ই-ট্রান্সফার, নগদ, বিকাশ, রকেট ইত্যাদির মাধ্যমে দেওয়ার সুযোগ রাখতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মো. মাইন উদ্দিন বলেন, কয়েকটি কারণে বিমা তামাদি হয়ে পড়ে। বিমা এজেন্টদের প্রথম তিন বছর অত্যধিক কমিশন দেওয়া হয়। ফলে তারা ‘চাকরি থাকবে না’ ইত্যাদি বলে পীড়াপীড়ি করে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের বিমা করান। প্রথম দুই থেকে তিন বছর ভালো উপার্জনের প্রত্যাশায় গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রিমিয়ামের টাকা সংগ্রহ করেন। এরপর আর খোঁজখবর নেন না। অন্যদিকে অনেক গ্রাহকও টাকার অঙ্ক তুলনায় কম থাকায় প্রথম কিছুদিন উৎসাহের সঙ্গে কিস্তি দেন। তারপর নানা কারণে না পারলে বন্ধ করে দেন। সমস্যা সমাধানের জন্য এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য