দেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বাদানুবাদ চলছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি দ্রুত নির্বাচন দাবি করছে। আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বিষয়ে সংস্কারের পর নির্বাচন হবে বলে বলা হচ্ছে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম গতবছর ১৭ ডিসেম্বর বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে কিংবা ২০২৬ সালের জুনে নির্বাচন হবে। আর দেশের আরেকটি অন্যতম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের ব্যাপারে গড়িমসি করছে। তারা নির্বাচনের পক্ষে হলেও দলটির অবস্থান বিলম্বের পক্ষে। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সংস্কারের পরই নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে মূল বিরোধের জড়িয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এই দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিরোধ এখন সবার মুখে মুখে। রাজনৈতিকভাবে এই দুই মিত্রের মধ্যে বিরোধ দিনদিন বাড়ছেই।
জানা গেছে, দেশে দ্রুত নির্বাচন হলে জামায়াত দলগতভাবে অংশ নিতে পারবে না। কারণ দলটির নিবন্ধন নেই। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধন নেই এমন কোনো দল নিজ দলের ব্যানার ও প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে না। এমন প্রেক্ষাপটে জামায়াত দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে দলটির নিবন্ধনের মামলা চলমান। এই মামলা নিষ্পত্তির ওপর তাদের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ভর করছে। আপিল বিভাগ থেকে দলটির অনুকূলে রায় হলেই কেবল ইসির নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পেতে পারে। সে পর্যন্ত দলটিকে অপেক্ষা করতে হবে। এই প্রক্রিয়াসম্পন্ন হতে কয়েক মাস লেগে যাবে। আর আপিল বিভাগে কবে নাগাদ মামলাটি নিষ্পত্তি হবে এবং আদালতের সিদ্ধান্ত দলটির অনুকূলে হবে কী না তা নির্ভর করছে পুরোপুরি আদালতের ওপর। আপিল বিভাগে জামায়াতের আপিলের ওপর শুনানি চলছে। আগামী ১৪ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, এরইমধ্যে আংশিক শুনানি হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ শুনানি শেষে রায় দেবেন আদালত। কবে নাগাদ এই রায় হতে পারে সেবিষয়ে তিনি বলেন, এটা নির্ভর করবে আইনজীবীদের শুনানি ও আদালতের ওপর।
জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে জামায়াতকে। আদালত থেকে কি সিদ্ধান্ত আসবে তা কারো জানা নেই। অনিশ্চিত এই অবস্থায় জামায়াত নির্বাচনে যেতে রাজি নয়। একারণেই নির্বাচন বিলম্বে হওয়ার পক্ষে দলটির অবস্থান বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা।
এছাড়াও দেশের রাজনৈতিক দল হিসেবে জনসমর্থনের দিক থেকে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির পর জামায়াতের অবস্থান। জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির অবস্থান বিরুদ্ধে হওয়ায় দেশে এখন প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও জামায়াত। এরইমধ্যে বিএনপির কতিপয় নেতার নানা অপকর্মের কারণে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। চাঁদাবাজ ও অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে নানা কথা উঠছে। যা প্রকারান্তরে বিএনপির বিরুদ্ধে যাচ্ছে। যদিও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শক্তহাতে অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এরপরও জামায়াত সংগঠিতকভাবে ওই জনমত নিজেদের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনের যত দেরি হবে, বিএনপির কতিপয় নেতার অপকর্মের মাত্রা ততই বাড়বে। আর এই সুযোগ নিয়ে জামায়াত নিজেদের পক্ষে ভোট বাড়াবে। তাছাড়া গত ১৫ বছরে দলটির শীর্ষ নেতাদের হারিয়েছে জামায়াত। ফলে নির্বাচন দেরি হলে দলটি নিজেদের গুছিয়ে নিতে আরও সময় পাবে। এই তিন কারণে জামায়াত নির্বাচন দেরিতে চাচ্ছে বলে জানা গেছে।
জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ। একই সঙ্গে আদালত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সনদ দেন, যা পরবর্তী সময়ে আপিল হিসেবে রূপান্তরিত হয়। ওই বছরের ২ নভেম্বর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এর পরই নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তালিকা থেকে জামায়াতের নাম বাদ দেয় ইসি। যদিও জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি। হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পর ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আপিল বিভাগে আপিল আবেদন দাখিল করে জামায়াত। একই সঙ্গে পৃথক লিভ টু আপিল আবেদন করা হয়। ওই দুটি আবেদন গতবছর ১৯ নভেম্বর খারিজ করেন আপিল বিভাগ। ওইদিন জামায়াতের পক্ষের আইনজীবীর অনুপস্থিতির কারণে আপিল বিভাগ আপিল খারিজ করে দেন। পরবর্তীতে আপিলটি পুনরুজ্জীবনের জন্য জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। গত ২২ অক্টোবর আদালত প্রায় একবছরের বিলম্ব মার্জনা করে আপিলটি শুনানির জন্য গ্রহণ (পুনরুজ্জীবিত) করেন আপিল বিভাগ। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে ইসির নিবন্ধন ফিরে পেতে জামায়াতের আইনি লড়াইয়ের পথ খুলে। এরই ধারাবাকিতায় গতবছর ১০ ডিসেম্বর থেকে ওই আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়েছে।
গতবছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ওইসময়কার প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের অপরাপর বিচারপতিরা পদত্যাগ করেন। এমন অবস্থায় ২৮৬ দিন দেরি মার্জনা করে আপিল এবং ২৯৪ দিন দেরি মার্জনা করে লিভ টু আপিল আবদেন পুনরুজ্জীবিত করার জন্য দলটির পক্ষ থেকে পৃথক দুটি আবেদন করা হয়। আবেদন দুটি গতবছর ১ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে ওঠে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সী আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের (বর্তমানে অবসর) হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুইবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দুইবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়।
এই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন (বর্তমানে অবসর), বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (পরে আপিল বিভাগের বিচারপতি ও গত ৬ আগস্ট পদত্যাগী) ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের (১৯ নভেম্বর পদত্যাগী) সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ। একই সঙ্গে আদালত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সনদ দেন, যা পরবর্তী সময়ে আপিল হিসেবে রূপান্তরিত হয়। এর আগে রায় ঘোষণার পরপরই তা স্থগিত চেয়ে জামায়াত আবেদন করে, যা ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের তৎকালীন চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ওই বছরের ২ নভেম্বর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এর পরই নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তালিকা থেকে জামায়াতের নাম বাদ দেয় ইসি। যদিও জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি।
নিবন্ধন হারানোর কারণে নিজের দলের ব্যানারে আর নির্বাচন করতে পারেনি জামায়াত। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে দলটি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতিক নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে দলটির নেতারা। তবে দলটির কোনো কোনো নেতা আপেল প্রতিক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন।
জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে গত ১ আগস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ১৮(১) ধারার ক্ষমতাবলে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যান। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এরপর গত ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধের আদেশ বাতিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এরপর থেকে রাজনৈতিক মাঠে কর্মসূচি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দলটির নেতাকর্মীরা।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য