- আরেক দফা বাড়বে জিনিসপত্রের দাম
- দাম বাড়বে না : অর্থ উপদেষ্টা
- প্রত্যাহারের দাবি জাতীয় নাগরিক কমিটির
শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর সরকারের মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধিতে জনমনে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এমন সরকারি সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ আরেক দফা বেড়ে যাবে। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চলমান লাগামহীন দামে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে এসে গত বৃহস্পতিবার শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করে দুটি অধ্যাদেশ জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ অধ্যাদেশ দুটি হলো- মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং দ্য এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫।
কোন কোন ক্ষেত্রে খরচ বাড়ছে : এই অধ্যাদেশের ফলে মোবাইল সেবার খরচ থেকে শুরু করে পোশাক, রেস্তোরাঁর খাবার, এমনকি মিষ্টি এবং ফলের মতো পণ্যেও বাড়তি ব্যয় গুণতে হবে।
মুঠোফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে মুঠোফোনে কথা বলা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বাড়বে।
ব্র্যান্ডের দোকান ও বিপণিবিতানের তৈরি পোশাকের আউটলেটে ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। সব ধরনের রেস্তোরাঁর ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে বাইরে খাওয়ার খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে।
খরচ বাড়ার অন্যান্য পণ্য ও সেবার মধ্যে রয়েছে- টিস্যু, ওষুধ, সিগারেট, বাদাম, ফলমূল (আম, আপেল, আঙুর, কমলালেবু, নাশপাতি), ফলের রস, চশমার ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, সানগ্লাস, ডিটারজেন্ট, রং, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, বিদ্যুতের খুঁটি, এলপি গ্যাস - এসব পণ্যের দামও বাড়ছে।
গত ১ জানুয়ারি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এনবিআরের প্রস্তাব পাস করা হয়। পরবর্তীতে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে অধ্যাদেশ আকারে এটি কার্যকর করা হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশকে দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে অর্থবছরের মাঝপথে এসে একশ’র বেশি পণ্য ও সেবায় শুল্ককর বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ধরনের কর এমন এক সময় বাড়ানো হলো, যখন দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে শুধু নিম্ন আয় ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ নয়; মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছে। তাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এখন নতুন শুল্ককর আরোপের ফলে এই শ্রেণির মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে।
সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আইএমএফের চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় এবং বাড়তি ঋণ পেতে শর্ত হিসেবে শুল্ককর বাড়ানোর মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সরকার যে খুশি মনে এটা করেছে, তা-ও নয়। সরকার মনে করেছে, আইএমএফের অর্থ পেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে এবং বিনিময় হারের চাপ কমবে। তাই সরকারকে এই পথে যেতে হয়েছে।
শুল্ককর প্রত্যাহারের জোরালো দাবি : সংকটের মধ্যে যারা পণ্যের ভ্যাট বাড়াতে পারে তারা সংজ্ঞা বুঝলেও অর্থনীতি বোঝে না বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, দেশের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের ঠিকই কিন্তু এরা অভিজ্ঞ নয়। তাই দেশ গড়তে আমাদের সাহায্য করতে হবে। তিনি বলেন, এত সংকটের মধ্যে যারা পণ্যের ভ্যাট বাড়াতে পারে তারা অর্থনীতির সংজ্ঞা বুঝে অর্থনীতি বোঝে না। খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা বোঝে না।
শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকার যে অধ্যাদেশ জারি করেছে, তা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। এই মুহূর্তে টিসিবির ট্রাক সেল চালু করারও দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির অবস্থান তুলে ধরেন সংগঠনটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি সরকার রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর জন্য দুটি অধ্যাদেশ জারি করেছে। ফলে মূল্যস্ফীতি ও ব্যবসায়ের খরচ বাড়বে, যা সাধারণ মানুষের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকার তার রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য করের আওতা বাড়াবে, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যাতে নেমে না যায় এবং তাদের ভোগান্তি যাতে না বাড়ে।
আখতার হোসেন বলেন, সরকার এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়াতে পারে, যা সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনমানের ক্ষতি করবে না। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে অবশ্যই সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যমান করের কাঠামোয় যে সীমাহীন দুর্নীতি হয়, তা বন্ধ করার উদ্যোগ নিলে রাজস্ব আয় বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
জীবনযাপনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না : পণ্য ও সেবায় ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) বাড়ানো হলেও সেটি সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিকে তেমন প্রভাবিত করবে না বলে মনে করছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এতে পণ্যের দামও বাড়বে না বা সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা এমন মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এতে জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের ডিউটি (শুল্ক) জিরো করে দিয়েছি। আপনি ছাড়টা দেখবেন। মূল্যস্ফীতির মূল ওয়েটের ইন্ডিকেটরগুলো হলো চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। আমরা যে সকল জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছি - এগুলো আমাদের মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, তিন তারকার ওপর যে রেস্তোরাঁগুলো- সেগুলোর ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। ভাতের রেস্টুরেন্ট বা অন্য রেস্টুরেন্ট থেকে তো যাবে না। থ্রেসহোল্ড আছে, যাদের টার্নওভার ৫০ লাখ টাকার ওপর, তাদের ক্ষেত্রে এটা আসবে। অন্য কোনো ব্যবসা তো এটার মধ্যে আসছে না।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নেপাল, ভুটান ধরেন বা বিশ্বের অন্য দেশ, এত লো (নিম্ন) ট্যাক্স কোথাও নেই সব জিনিসের ওপরে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ক্ষেত্রে আমরা সবসময় বলেছি, সেখানে আমরা (কর) প্রায় জিরো করে নিয়ে আসবো।
উপদেষ্টা বলেন, চূড়ান্তভাবে ভোক্তা ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিচ্ছে না। ইনপুটের জন্য সে রিবেট পাবে। জিজ্ঞেস করেন, সেটা ওরা জানে।
আইএমএফের পরামর্শে এটি করা হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, না, সবদিক চিন্তা-ভাবনা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মনে হয় না কষ্ট হবে। জনগণের স্বস্তি না পাওয়ার তো কোনো কথা না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইটি খাতে আমরা বরাদ্দ কমাব না, বরং আমরা বৃদ্ধি করব। কিন্তু আমাদের রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ধার করে বেশিদিন চলা যায় না।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য