বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করা হয়েছে। আর প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ করার প্রস্তাবও করেছে কমিশন। একইসঙ্গে বর্তমান সংবিধানে বিদ্যমান রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির মধ্যে ‘গণতন্ত্র’ বহাল রেখে তিনটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন আরও চারটি মূলনীতি সংযোজনের সুপারিশ করেছে কমিশন। নতুন চারটি মূলনীতি হলো-সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও বহুত্ববাদ। সবমিলে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি রাখা হয়েছে পাঁচটি।
সুপারিশ অনুযায়ী আইনসভা হবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট, যার মেয়াদ হবে চার বছর। প্রধানমন্ত্রী পদে দু’বারের বেশি নয় এবং প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি পদেও দুইবারের বেশি নয় এবং তিনি নির্বাচিত হবেন নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে। এছাড়া সংসদ মেয়াদ শেষ হলে বা কোন কারণে ভেঙে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে সংবিধান সংস্কারে।
জানা গেছে, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে ১৫০ সুপারিশ করেছে কমিশন। পুলিশবাহিনীর সংস্কারে ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে সংশ্লিষ্ট কমিশন। দুদক শক্তিশালী করতে ৪৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তার কার্যালয়ে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ সংস্কার ও দুদক সংস্কারে গঠিত কমিশন প্রধানরা সুপারিশসমূহ জমা দিয়েছেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রিয়াজ, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামানসহ কমিশনগুলোর সদস্যরা এসময় উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন- ফেব্রুয়ারি মাঝামাঝিতে সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করা হবে। সেখান থেকে মতামত নিয়ে সংস্কারের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে।
সংবিধান সংস্কারে প্রস্তাব : সংবিধান সংস্কারের সুপারিশে গণতন্ত্র বহাল রেখে রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির মধ্যে তিনটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার নতুন আরও চারটি মূলনীতির সুপারিশ করেছে তারা।
বর্তমানে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যে চার মূলনীতি রয়েছে সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাহাত্তরে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, তাতে রাষ্ট্র পরিচালনার এই চার মূলনীতি গৃহীত হয়েছিল। বর্তমানের চার মূলনীতির মধ্যে শুধু গণতন্ত্র রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত পাঁচ মূলনীতির মধ্যে। সুপারিশ করা নতুন চারটি মূলনীতি হলো-সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও বহুত্ববাদ। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের জনআকাঙ্খার প্রতিফলনস্বরূপ সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে এই পাঁচটি নীতি প্রস্তাব করা হয়েছে।
আর তিন মূলনীতি বাদ দেওয়ার বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশন সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করছে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংস্কারের সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে কমিশন। এর মধ্যে একটি হবে নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ (ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) এবং আরেকটি উচ্চকক্ষ (সিনেট)। উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর। আর একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে দুবারের বেশি হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না। এ ছাড়া সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ২১ বছর করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন। নির্বাচন করার জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছে। এটি মূলত কাজের দিক দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো।
এ বিষয়ে কমিশন যে সুপারিশ করেছে, সেগুলো হলো:১. কমিশন আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত, একটি অন্তর্র্বতী সরকার নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।২. সরকারের প্রধান ‘প্রধান উপদেষ্টা’ বলে অভিহিত হবেন। আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে অথবা আইনসভা ভেঙে গেলে, পরবর্তী অন্যূন ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা সর্বোচ্চ ১৫ (পনেরো) সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করবেন।
'বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে সংস্কারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে' অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে নয় সদস্যের সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। তিন মাস ধরে সাধারণ নাগরিক, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনদের কাছ থেকে মতামত সংগ্রহ করে কমিশন। প্রায় এক লাখ লোকের মতামত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন। সেই সাথে তারা বিভিন্ন দেশের সংবিধানও পর্যালোচনা করেন।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী বলেন, সংস্কারের প্রস্তাবনা তৈরি করার ক্ষেত্রে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ রোধ, ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন, জবাবদিহিতা, রাষ্ট্র পরিচালনায় সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার মত বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়েছেন তারা। কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবের পাঁচটি মূল দিক তুলে ধরা হয়েছে সংস্কার প্রস্তাবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে কমিশনের ১৫০ সুপারিশ: নির্বাচন কমিশন সংস্কারে ১৫০ ছোট বড় সুপারিশ তুলে ধরে সংস্কার প্রস্তাবণা দিয়েছেন কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, আমরা ‘ভাঙা’ নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে অন্তর্ভূক্তিমূলক করার পাশাপাশি সব অংশীজনকে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনার লক্ষ্যে প্রায় ১৫০ সুপারিশ রেখেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।
তিনি বলেন, এটা একটা গুরু দায়িত্ব ছিল আমাদের। নির্বাচন ব্যবস্থা ‘ভেঙে’ গিয়েছে, এটাকে জোড়া লাগানোর জন্য এই সংস্কার কমিশনের প্রচেষ্টা। কাজটি করতে গিয়ে তিনি উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ছিলেন এবং সামনের দিনে আরও উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন।
তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থায় যাতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হয় সে চেষ্টাই করার কথা তুলে ধরেছেন তিনি। একই সাথে সব অংশীজনের দায়বদ্ধতা যেন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচনটা যেন অন্তর্ভূক্তিমূলক হয়, ভোটারের ভোট দেওয়ার অধিকার যাতে প্রতিষ্ঠিত হয় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করেছি।
তিনি বলেন, গ্রামের থেকে অনেক মানুষ এসেছে কথা বলতে। অনেকে বলে গিয়েছে- সংসদ ভবনের এ ইমারতে যেন কুৎসিত লোক আসতে না পারে। আমরা মনে করি- এটা ছিল আমাদের প্রতি ম্যান্ডেট। ৮টি উল্লেখযোগ্য জায়গায় ১৫০টির মতো সুপারিশ করেছি। এ সুপারিশের অন্যতম লক্ষ্য- নির্বাচন কমিশনের (ইসি) স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। তাদের ক্ষমতায়িত করা। একই সাথে তাদের দায়বদ্ধ করা। দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা যাবে, সে আশা করাও দুরাশা বলে মন্তব্য করেন কমিশন প্রধান।
রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক চর্চা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়ে তিনি বলেন, দায়বদ্ধতার বিধান অন্তর্ভুক্ত করেছি। এটা চারটিখানি কথা নয়। এটা বলা সহজ; কিন্তু এটা আমাদের করতে হবে। বহু বছর ধরে প্রবাসীরা ভোটাধিকার বঞ্চিত তুলে ধরে বদিউল আলম বলেন, তাদের যাতে ভোটাধিকার দেওয়া যায়, তাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সুপারিশে। প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়ে কিছু ‘অভিনব’ প্রস্তাবও করা হয়েছে।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বিষয়ে তিনি বলেন, এখন যে ব্যবস্থা রয়েছে তা আলঙ্কারিক। তা অসম্মানিত করে। আমরা ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেছি। নির্বাচনী অপরাধের বিচার সুসংহত করে তাদের যেন দায়বদ্ধ করা যায় সে বিষয়ে সুপারিশ করেছি।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভোটের কথা উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিশেষত গত তিনটি নির্বাচনে যারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে নির্বাসনে ফেলে দিয়েছে। কর্মকর্তা শুধু নয়, আমাদের কমিশন সদস্যরা, তাদের ব্যাপারে তদন্ত করার, বিশেষত ২০১৮ সালের মধ্যরাতে অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটেছে সে ব্যাপারে তদন্ত করে তাদের বিচারের আওতায়, দায়বদ্ধতার আওতায় আনা বলে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আরও দুই-একটা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিছু আইন রয়েছে সংস্কার করা দরকার। ইতোমধ্যে কিছু গুছিয়ে আনা হয়েছে। এজন্য সময় দিতে হবে।
সংস্কার কমিশনের এই কাজকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে তুলে ধরে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “এটা আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এসাইনমেন্ট ছিল।”
পুলিশের সংস্কারে ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে কমিশন: বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও আসামিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা চেয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। এছাড়া বাহিনী সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে এই কমিশন।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বুধবার ওই প্রতিবেদন জমা দেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন। তিনি বলেছেন ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি পুলিশকে তিন হাজারের বেশি আইন নিয়ে কাজ করতে হয়।
সব আইন খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। তবে এ ২২টি আইনের হয় সংশোধন, পরিমার্জন বা কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতে হবে। ওই ২২টি আইনের কোন কোন ক্ষেত্র আমাদের আপত্তি আছে বলেও আমরা সুপারিশ করেছি।
তিনি বলেন, এটার ব্যপারে আমরা কোন আইডিয়া দেইনি। ইউরোপের মডেলটাই ফলো করতে বলেছি। সেটার ব্যপারে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে ডিটেল একটা গাইডলাইন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ইউজ অব ফোর্স ৫টা স্তরে হবে। বেআইনি সমাবেশ, শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে যে শক্তি প্রয়োগ করা হয়, এ শক্তি প্রয়োগটা পরিস্কার হয়ে যাবে। ক্রাউডের ক্ষেত্রে কী কী করতে হবে। ভবিষ্যতেও যদি কোন ঘটনা ঘটে কেউ প্রাণহীন হবে না।
জুলাই-অগাস্টে সরকার পতনের আন্দোলন দমাতে ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ উঠে। আন্দোলনে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারের কাছে পুলিশের তরফ থেকে ক্ষমা প্রার্থনাও করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কারের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার আনতে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে।
প্রতিবেদনে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়েও সুপারিশ করেছে এই কমিশন। সফর রাজ হোসেন বলেন, দুটো ক্ষেত্রেই হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের কিছু নির্দেশনা আছে, সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যেত তাহলে হয়ত বা জনসাধরণের কষ্ট লাঘব হত। এক্সেসিভ ফোর্স ব্যবহার, নির্বিচারে কোন গ্রেপ্তার করতে পারত না। নির্দেশনা মানতে হতো। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এটার একটা রিভিউ পিটিশন দেওয়া আছে, যার ফলে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অনুরোধ করেছি, সরকার যেন এটা উইথড্রো করে, তাহেলেই ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এটার জন্য যেটা প্রয়োজন আইন মন্ত্রণালয় হয়ত করবেন।
এছাড়া প্রতিটি থানায় নারী পুলিশের জন্য যেন একটি ডেস্ক করার সুপারিশ করা হয়েছে। ওই ডেস্ক ২৪ ঘণ্টা যেন একজন মহিলা সাব-ইন্সপ্রেক্টর থাকেন, এসআই থাকেন, কন্সটেবল থাকেন। যাতে মহিলা আসামিকে জেরা করা, কোর্টে আনা নেওয়া করা এবং মহিলা অভিযোগকারী যদি আসে এজন্য সুপারিশ করেছি। হয়ত দীর্ঘ সময় লাগবে কিন্তু বাসন্তবায়ন যোগ্য। এই সুপারিশগুলো অবিলম্বে, মধ্য মেয়াদী, দীর্ঘ মেয়াদী সময়ে বাস্তবায়ন যোগ্য বলে জানিয়েছেন সংস্কার কমিশনের প্রধান।
তিনি বলেন, দীর্ঘ মেয়াদী সুপালিশগুলো বাস্তবায়নে আর্থিক ব্যবহার বা কোন কোন ক্ষেত্রে হয়ত আইন পরিবর্তন করতে হতে পারে। চাকরির জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়ে কমিশন যে সুপারিশ করেছে সেগুলো শিগগিরই বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করেন সফর রাজ প্রধান।
তিনি বলেন, এটার ক্ষেত্রে খুব ইজি করা সম্ভব। কারণ এখন ন্যাশনাল আইডি কার্ড হয়েছে। চাকরির সময় আত্মীয় স্বজন রাজনীতি করে কিনা এটা দেখা হতো। এসবির সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা সুপারিশ করেছি যাতে সহজ হয় ভবিষ্যতে। এবং এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তারা হয়ত আমারের সুপারিশের প্রেক্ষিতে এটা পরিবর্তন করবেন।
গেল বছরের ৩ অক্টোবর সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বাধীন গঠিত এ কমিশনকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। সে হিসেবে ২ জানুয়ারির মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমার কথা ছিল। পরে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার মেয়াদ এক দফা বাড়িয়ে ১৫ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়। পুলিশ সংস্কারের জন্য সুপারিশ তৈরি করতে সাধারণ মানুষের মত নিয়েছে কমিশনটি। সেই সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এ বাহিনীকে ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ করার ওপর জোর দেন।
বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, সব জায়গায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রয়েছে। সেটা ঠিক করতে না পারলে কোনোভাবেই পুলিশ সংস্কার সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক আমলাতন্ত্রের কারণে পুলিশ নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে পুলিশকে স্বতন্ত্র কমিশনের অধীনে রাখার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুদক শক্তিশালী করতে ৪৭ সুপারিশ: ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সংবিধানের অঙ্গীকার, দুর্নীতি বিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন, ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা ও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিলের প্রস্তাবসহ ৪৭ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশন। দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান জানিয়েছেন বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এসব সুপারিশ তুলে ধরে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
দুদককে শক্তিশালী করতে আট সদস্যের কমিশনের তৈরি করা সংস্কার প্রতিবেদন নিয়ে সরকার প্রধানের কার্যালয়ে কথা বলছিলেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি দুর্নীতি দমন কমিশনের মত প্রতিষ্ঠান কোন দেশেই এবং বাংলাদেশেও এককভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তার উপরে কেন্দ্রীয় দায়িত্ব নীতিনির্ধারণের কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত রাষ্ট্র এবং সামাজিক পরিবেশ লাগে। পুরো রাষ্ট্র এবং সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হয় এর অবকাঠামোতে। সেই বিবেচনায় আমরা আমাদের সংবিধানের ২০ এর ২ অনুচ্ছেদে যেটা আছে সেটার সংশোধন করতে চাই। সেটা হচ্ছে, সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সংবিধানের একটা অঙ্গীকার।
তার কথায়, রাষ্ট্র এবং আইনি ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুবিধা অর্জনে যে ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশে সেটা প্রতিরোধ করতে তার বিরুদ্ধে সাংবিধানিক অঙ্গীকার লাগবে। যদিও এর সুযোগ আমাদের সংবিধানে আছে।
দুর্নীতি বিরোধী কৌশলপত্র বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোনো জাতীয় দুর্নীতি বিরোধী কৌশল নাই। কোন নীতিমালা নাই। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে সুপারিশ করছি, কৌশলপত্র প্রণয়ন করতে হবে। যার মধ্যে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক কাঠামোতে দুর্নীতি বিরোধী শুধু প্রত্যয়ই না, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যে অঙ্গীকারগুলো দরকার, দায়িত্ব এবং কর্তব্য সেটি নির্ধারণ করা।
দুনীতি বিরোধী কৌশল প্রতিপালিত হচ্ছে কী না সেটি পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়নের জন্য সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ন্যায়পালের গুরুত্ব তুলে ধরেন এই সংস্কার কমিশনের প্রধান।
তিনি বলেন, ন্যায়পালের একটা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যাদের দায়িত্ব হবে এই কৌশলের বাস্তবায়ন বা প্রতিফলনের মূল্যায়ন করা। ধারাবাহিকভাবে, নিয়মিতভাবে।
দুর্নীতি রুখতে কালো টাকা সাদা করার বৈধতা ‘স্থায়ীভাবে বন্ধ চাইছেন’ ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, এরপর যেটা জোরালোভাবে সুপারিশ করতে চাই, কালো টাকা বৈধতা দেওয়ার বাৎসরিক রীতি আমাদের রাষ্ট্রীয় বা সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে বাংলাদেশে, সেটির চিরতরে বন্ধ করতে হবে।
দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের নিয়ে তার ভাষ্য, আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের সাধ্যমত যাতে মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন করে এমন একটি প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য। এবং সে লক্ষ্যেই অন্যান্য কমিশনের মত যথাযত গবেষণা এবং জনসম্পৃক্ততা কার্যক্রম শেষ করেই আমাদের প্রতিবেদন সম্পন্ন করেছি।
নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছিল ৩ অক্টোবর। আর সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল ৬ অক্টোবর।
এরপর গত ১৮ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা হয় গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী বিষয়ক ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমার কথা থাকলেও প্রথম ধাপে গঠিত ছয়টি কমিশনের মেয়াদ পরে বাড়ানো হয়। এর মধ্যে চার কমিশন বুধবার প্রতিবেদন দিল।
এই কমিশনগুলো ওয়েবসাইট খুলে মতামত সংগ্রহ, অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ, মতবিনিময়, জরিপ ও লিখিতভাবে মতামত সংগ্রহ করেছে। সুপারিশমালা প্রস্তুতে এসব প্রস্তাব ও মতামত পর্যালোচনা করা হয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনায় বসবে সরকার: সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাব নিয়ে আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক শুরু হবে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গতকাল বুধবার সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট প্রকাশের পর বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, এই রিপোর্ট নিয়ে সংস্কার কমিশন বসবে। এখান থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে, সেটি চূড়ান্ত করা হবে। এসময় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যাশিত সংস্কার শেষ করতে আগামী বছরের জুন মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করতে পারবে কী -না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, জুলাইয়ে সংগঠিত বিচারিক প্রক্রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি আমরা। রায়ে অপরাধের সাথে কোন দলের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে সেটার আলোকে বহু সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পাবো। তবে তিনি জানান, কোন দলকে আগে থেকে নিষিদ্ধ করবে না সরকার।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য