নদীর ‘ট্যাক্স’ হাত বদল

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
নদীর ‘ট্যাক্স’ হাত বদল

কার্গো জাহাজচালক শামীম আহমেদ প্রায় তিন দশক ধরে নদীপথে মালামাল পরিবহনের কাজ করেন। এ পথে চাঁদাবাজি আর ডাকাতির ঘটনা তার প্রায় নিত্যদিনের সঙ্গী। আগে কখনো তাকে মারধরের শিকার হতে হয়নি। কারণ চাঁদা নিতে এলে চাঁদা দিয়েছেন, ডাকাত উঠলে সবকিছু দিয়ে দিয়েছেন; কখনও ‘ঝামেলা’ হয়নি। কিন্তু গতবছর সেপ্টেম্বরে ডাকাতের কবলে পড়ে ব্যাপক মার খেতে হয়েছে তাকে। তার আরেক সঙ্গীকে ডাকাতরা পিটিয়ে আহত করেছে। টানা পাঁচদিন বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হয়েছেন।

সেদিন শামীম কার্গো জাহাজে পাথর নিয়ে চাঁদপুরের দশআনি থেকে সাতক্ষীরায় যাচ্ছিল। পথে মেঘনায় ভাটার কারণে চরায় ঠেকে যায়। তখন সকাল সাড়ে ১০টা। জাহাজে তারা পাঁচ-ছয়জন ছিলেন। হঠাৎ করেই ৩০ থেকে ৩৫ জনের একটি দল জাহাজে উঠে পড়ে এবং ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়। শামীম প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো চাঁদা নিতে এসেছে। কিন্তু ডাকাতরা কোনো টাকা-পয়সা না চেয়ে তাকে এবং তার এক সহযোগীকে মারধর শুরু করে।

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অন্যরা টয়লেট, পানির ট্যাঙ্ক আর ইঞ্জিনের নিচে গিয়ে লুকিয়ে পড়েন। ডাকাতদল মারধর করে দুটি মোবাইল, ১০ হাজার টাকা, চালের বস্তা, গ্যাসের চুলা ও কাপড়-চোপড় সব নিয়ে যায়। পরে অন্য একজনের সহায়তায় শামীম জাহাজ নিয়ে বরিশালের চারমমোনাই ঘাটে নোঙর করেন। তাকে সেখান থেকে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের আরোয়াইল গ্রামের ছেলে শামীম ১২ বছর বয়সে নৌকায় উঠেছিলেন। তিন দশক ধরে তিনি নৌ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। এখন তিনি জাহাজের সুকানি। বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনেরও সদস্য তিনি।

শামীম বলছিলেন, তিনি সারাদেশেই মালামাল নিয়ে যান। ওই সময় হাইমচর-হিজলার মোড়-কালীগঞ্জ নৌপথে চাঁদাবাজি ও ডাকাতির ঘটনা বেশি ঘটত। মেঘনার উজানে নারায়ণগঞ্জের বৈদ্যের বাজার-নুনের টেক এবং সুনামগঞ্জের ছাতক নৌপথে যাতায়াতও ভীতিকর অবস্থায় পৌঁছেছে। সুনামগঞ্জ আর ছাতক মিলিয়ে অন্তত চারবার চাঁদা দিতে হয়। তার কথায়, এরা সাধারণ, মাঝারি ধরনের নৌকায় জাল নিয়ে ঘোরাফেরা করে। দেখলে মনে হবে মাছ ধরছে। কিন্তু ভাটার মধ্যে জাহাজ আটকে গেলে কিংবা একটু নির্জনে পড়লেই এরা একসঙ্গে এসে দা-বল্লম নিয়ে হামলা চালায়। নৌপথে এটা এখন ভয়াবহ হয়ে ওঠেছে। ডাকাত বা চাঁদাবাজরা নৌকা, স্পিডবোট নিয়েও আসে। এ থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি না।

বরিশালের মল্লিকপুর থেকে আলীগঞ্জ পর্যন্ত মেঘনা নদীর দুই কিলোমিটার এলাকা নৌ শ্রমিকদের জন্য আতঙ্কের। ওই জায়গাটি তিনভাগে ভাগ করে আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে চাঁদা তোলা হত। ৫ আগস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও চাঁদার পরিমাণ বদলায়নি; বদলেছে শুধু দল ও নেতার নাম।

এই পথ দিয়ে প্রতিদিন চলাচলকারী প্রায় ২০০ পণ্যবাহী ট্রলার, নৌকা, জাহাজকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিয়ে যাতায়াত নিরাপদ করতে হয়। নাহলে নির্দয় মারধরের পাশাপাশি লুটপাটের শিকার হতে হয় নৌ-পরিবহনের শ্রমিকদের। তারা এটাকে বলে ‘নদীর ট্যাক্স’। এর বাইরে ডাকাতির ঘটনা তো আছেই।

প্রকাশ্য এই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ করা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। বরং অনেক ‘অসৎ কর্মকর্তা’ এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। বরিশালের নৌ পুলিশ সুপার নাজমুল হক অবশ্য বলছেন, তাদের অভিযান চলছে। তারা চেষ্টা করছেন চাঁদাবাজি বন্ধ করতে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে নৌ পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।

হিজলা উপজেলার আলীগঞ্জ বাজারে গেলে নৌ-পরিবহন শ্রমিকদের অনেকের সঙ্গেই কথা হয়। নদী থেকে চাঁদা তোলেÑ এমন একটি দলের একজনও সেখানে ছিলেন। কয়েকদিন আগেই চাঁদপুরে একটি সারবাহী জাহাজে সাত খুনের ঘটনা ঘটে। শ্রমিকদের মধ্যে সেই আতঙ্ক তখনও বিরাজমান। চাঁদাবাজি ও ডাকাতির ঘটনাকে তারা এক ধরনের ‘নিয়তি’ বলে মেনে নিয়েছেন। তারা বলছিলেন, মেঘনা নদীর হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জের সীমান্তবর্তী দুই কিলোমিটারের মধ্যে তিনটি পক্ষ প্রতিদিন পণ্যবাহী নৌযান থেকে বিভিন্ন হারে চাঁদা তোলে।

সুকানি মো. রিয়াজ কাজ করেন মা এন্টারপ্রাইজ নামের এক বাল্কহেডে। তিনি বলেন, কালিগঞ্জে ৫০০ এবং কালিগঞ্জের পরে ও আলীগঞ্জে ২০০ করে মোট ৪০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে এসে চাঁদা নেয়। টাকা না দিলে মারধর করে, মোবাইল ফোন নিয়ে যায় ও গালাগাল করে। তিনি বলেন, নৌকায় উঠেই বলবে, নদীর ট্যাক্স দে। নদীতে নৌকা চালাতে হলে আমাদেরকে ট্যাক্স দিতে হবে। অহেতুক মারধর ও গালাগালি থেকে রক্ষা পেতে টাকা দিয়ে চলে যাই।

আরেক কার্গো জাহাজের সুকানি মো. ইব্রাহিম বলেন, জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করে তাদের চলতে হয়। তাদের পণ্যবাহী নৌযান হাইমচর এলেই শুরু হয় আতঙ্ক। জরুরি নম্বর ৯৯৯-এ কল করেও পুলিশের সেবা পাওয়া যায় না। কারণ যারা অপকর্ম করে তারা নৌ-পুলিশের দুই ফাঁড়ির মধ্যবর্তী এলাকায় এসে করে। এমনকি কোস্টগার্ড কাছাকাছি নেই এমন এলাকাতেও চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করে।

পুলিশ ও কোস্ট গার্ডের কাছে অভিযোগ দিলে এক সপ্তাহ বা ১০ দিন চাঁদাবাজি বন্ধ থাকে। সবকিছু স্বাভাবিক হলেই আবার শুরু হয়। ইব্রাহিমের অভিযোগ, তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ ও কোস্ট গার্ড কাজ করে না। উপরন্তু সেই তথ্য উল্টো চাঁদাবাজ ও ডাকাতদের কাছে পৌঁছে যায়। ইব্রাহিম বলেন, শুনেছি, চাঁদার একটি অংশ সংশ্লিষ্ট থানায়ও যায়। তিন স্থানে চাঁদাবাজি ছাড়াও জেলের ছদ্মবেশে ডাকাতি হয় জানিয়ে ইব্রাহিম বলেন, তারা ২৪ ভোল্টের ব্যাটারি, মোবাইল ফোন, নগদ টাকা নিয়ে যায়। এমনকি নতুন জামা-কাপড় থাকলে তাও নিয়ে যায়। স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, আগে আওয়ামী লীগের লোকজন চাঁদা তুলত। এখন তোলা হয় বিএনপির লোকজনের নামে। শুধু দলীয় পরিচয় ও হাতের বদল হয়েছে। চাঁদা নেওয়া বন্ধ হয়নি। তিনি বলেন, মেঘনা নদীর মল্লিকপুর থেকে কালিগঞ্জ পর্যন্ত এলাকায় চাঁদা তোলা হয় মেহেন্দিগঞ্জের গোবিন্দপুর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মিজান মাঝির লোকজন। কালিগঞ্জ থেকে দেওনা দীঘির পাড় পর্যন্ত এলাকায় বরিশাল উত্তর জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মিল্টন চৌধুরীর লোকজন এবং দেওনা দীঘির পাড় থেকে আলীগঞ্জ বাজার পর্যন্ত এলাকায় হিজলার ধুলখোলা ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আলম চকিদার এবং হারুন মৃধার লোকজন চাঁদা তোলে।

প্রতিদিন বেলা ১২টা থেকে বিকাল ৩টা এবং বিকাল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চাঁদা উত্তোলন করা হয়। মিজান মাঝির লোকজন ইঞ্জিনচালিত নৌকা, মিল্টন চৌধুরীর লোকজন ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও স্পিডবোট এবং আলম চকিদার ও হারুন মৃধার লোকজন ইঞ্জিনচালিত নৌকা দিয়ে চাঁদা নেয়। তিনি বলেন, তিনটি পক্ষকে চাঁদা দিয়ে ওই এলাকা অতিক্রম করতে হয় প্রতিটি নৌযানকে। ওই এলাকা দিয়ে প্রতিদিন দেড় থেকে ২০০ পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করে।

স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে এসব নৌযান থেকে চাঁদা তুলত স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য পংকজ নাথ এবং আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদের অনুসারীরা। বর্তমানে চাঁদা উত্তোলনকারী তিনটি পক্ষই স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসানের অনুসারী।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের বরিশাল বিভাগীয় সভাপতি আবুল হাসেম মাস্টার বলেন, মল্লিকপুর, কালিগঞ্জ ও আলীগঞ্জ এলাকায় ট্রলার নিয়ে এসে চাঁদাবাজি করে। শুধু চাঁদাবাজি না, প্রায় প্রতিমাসে পণ্যবাহী নৌযানগুলো ডাকাতির শিকার হয়। বিষয়টি নিয়ে হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ থানা, নৌ পুলিশ ফাঁড়ি ও কোস্ট গার্ডকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি। তারা নেই-নিচ্ছি বলে জানিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। চাঁদাবাজি ও ডাকাতি চলছেই।

কোস্ট গার্ডের দক্ষিণ জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট সাব্বির আহমেদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন তারা। সেটা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আমরা হোতাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আমরা খবর পেলেই অ্যাকশনে যাচ্ছি। ১ জানুয়ারি ডাকাতির খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে নৌযানের আহত নাবিকদের উদ্ধার করে ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করেছি। আমাদের অভিযান আগের থেকে অনেক বাড়ানো হয়েছে। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিয়ে ফেলা যাবে। তবে চাঁদাবাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নৌ-পুলিশ ও কোস্টগার্ডের কর্মকর্তারা।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য