নতুন বছরের ১৯ দিন চলে গেছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছেনি পাঠ্যবই। সব পাঠ্যপুস্তক বিতরণের সময় নিয়ে সরকারের দুই দায়িত্বশীল ব্যক্তির দু’ধরনের বার্তায় বিপাকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। আগামী মার্চের আগে সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন পাঠ্যবই পৌঁছানো সম্ভব হবে না বলে জানিয়ে রেখেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা। আর আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সবার হাতে নতুন বই দেওয়া হবে বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। ছেলেমেয়েদের খুশি রাখতে বাজার থেকে গাইড বই কিনে দিচ্ছেন অনেক অভিভাবক। বইয়ের পিডিএফ থেকে প্রিন্ট নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে বিরাজ করছে বই না পাওয়ার চাপা ক্ষোভ।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, ২০২৫ সালের পাঠ্যবই নিয়ে মহাসংকটে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ভিন্ন ভিন্ন আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছেন না শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখন ঘাটতির শঙ্কা জন্মেছে তাদের মনে। স্কুল-কলেজে এক শিক্ষাবর্ষে সাধারণত ৭৬ দিনের ছুটি থাকে। এর সঙ্গে দুই দিন করে সাপ্তাহিক ছুটি যোগ করলে আরো ১০৪ দিন বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই হিসাবে এক বছরে ক্লাস-পরীক্ষা চলে ১৮৫ দিন। আর এই অনুসারেই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আগামী মার্চের প্রায় শুরু থেকেই রোজা ও ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার কথা। এখন বই হাতে পাওয়ার পর যদি ছুটি শুরু হয়ে যায়, তাহলে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ ছাড়া পুরোপুরিভাবে ক্লাস শুরু করা সম্ভব নয়। এতে এক বছরের সিলেবাস আট মাসে শেষ করতে হবে। শিক্ষকরা এই সময়ে জোর করে পড়া চাপিয়ে দিলেও শিক্ষার্থীরা তা ঠিকমতো আয়ত্তে নিতে পারবে না। এতে আগামী বছর বড় ধরনের শিখন ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
শিক্ষকরা বলছেন, গত দুই বছর নতুন শিক্ষাক্রমে পড়ালেখা করেছে শিক্ষার্থীরা। সেখানে ভিন্নধর্মী পড়ালেখায় শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো চাপ নিতে হয়নি। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যেতে হয়েছে। এতে এমনিতেই বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে শিক্ষার্থীরা।
অনেক শিক্ষার্থীই তাল মেলাতে পারছে না। তারা এ বছরের বার্ষিক পরীক্ষায় খুব খারাপ করেছে। এখন যদি আবার বই পেতে পেতে তিন মাস সময় চলে যায়, তাহলে বড় ধরনের দুর্ভোগে পড়বে শিক্ষার্থীরা।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কিশলয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ বলেন, শিক্ষার্থীরা যেভাবেই হোক, পাঠবিমুখ হয়েছে। এখন বই যদি দেরিতে পাওয়া যায়, তাহলে এক বছরের শিক্ষাক্রম কম সময়ে শেষ করতে হবে। এতে শিক্ষকদের যেমন চাপ নিতে হবে, তেমনিভাবে শিক্ষার্থীদের আরো বেশি চাপ নিতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী চাপ নিতে পারবে না, তারা শিখন ঘাটতিতে পড়বে। তবে আমরা সাধারণত দেখি, ক্লাস না হলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসে না। তাই যত দিন পুরোপুরিভাবে ক্লাস শুরু না হয়, তত দিন সহশিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করার পরামর্শ থাকবে বলে জানান অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ।
দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, এ বছর চুক্তির পর বই ছাপার কাজ শেষ করতে সময় দেওয়া হয়েছে মাত্র ৪০ দিন। কিন্তু আগের বছরগুলোতে এই সময় ৭০ দিন দিয়েও যথাসময়ে বই পাওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ এ বছর সব কাজ একসঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। ফলে কোনোভাবেই ৪০ দিনে বই দেওয়া সম্ভব নয় বলে প্রেস মালিকরা জানিয়েছেন। কিন্তু সব কিছু জেনে-বুঝেও তাদের অবাস্তব চাপ দিচ্ছে এনসিটিবি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছর সাধারণত জুলাই-আগস্ট থেকে পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু হয়। এরপরও ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ বই দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু এ বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এনসিটিবিতে অনেক পরিবর্তন আসে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, সদস্য ও অন্য কর্মকর্তারা পরিবর্তন হন।
এরপর আবার আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া হয়। পাঠ্যক্রমেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু এনসিটিবির নতুন কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও পরিকল্পনার অভাবে এই পাঠ্যবইয়ের কাজ অনেক পিছিয়ে গেছে। নয়তো আরো অন্তত ১৫ থেকে ৩০ দিন আগে বেশির ভাগ বই ছাপার কাজ শুরু করা সম্ভব হতো।
চলতি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য মোট ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই ছাপছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে আট হাজারের বেশি ব্রেইল বই এবং শিক্ষকদের জন্য ছাপা প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা বই ছাপা হচ্ছে।
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মোট চার কোটি ৩৪ লাখ তিন হাজার ২৮৩ জন শিক্ষার্থী ধরে নিয়ে পাঠ্যবই ছাপছে এনসিটিবি।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একেএম রিয়াজুল হাসান জানান, এবার ১১৬টি প্রেস (ছাপাখানা) পাঠ্যবই ছাপছে। আমরা যখন দরপত্র আহ্বান করি, তখন প্রিন্টার্সরা (ছাপাখানা মালিক) বলেছিল- তারা দৈনিক এক কোটি ৪২ লাখ বই ছাপাতে পারবেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তারা দৈনিক ১৫ থেকে ২০ লাখ বই ছাপতে পারছেন।
প্রেসগুলো তাদের ‘সক্ষমতা প্রদর্শন’ করছে না অভিযোগ করে তিনি বলেন, তারা কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া ও আর্ট কার্ড (বইয়ের মলাটের কাগজ) সংকট এবং ব্যাংকের সমস্যার (ঋণ পাওয়া) কথা বলছেন। আসলে বাজারে এগুলোর কোনো সংকট নেই। দামও খুব বেশি বাড়েনি। ব্যাংকের সমস্যাও আমরা সমাধান করে দিচ্ছি। কারণ তারা বিতর্কিত ব্যাংকগুলো থেকে টাকা পাওয়ার চেষ্টা করেছিল।
ড. রিয়াজুল হাসান বলেন, যারা পাঠ্যবই ছাপার কাজ নিয়েছে, তারাই আবার নোট-গাইড ছাপছেন, কাগজ-কালির ব্যবসা করছেন। একসঙ্গে তারা অনেক বেশি কাজ নিয়েছেন। তাছাড়া আমরা বই ছাপার জন্য তাদের যে টাকা দিচ্ছি, তাতে প্রতি টন কাগজ এক লাখ ৪৮ হাজার টাকায় কিনলেও তাদের লাভ হয়।
তবে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, যারা নোট-গাইড ছাপছে তাদের ধরছে না কেন এনসিটিবি? এটাতো তাদেরই কাজ। আর বর্তমানে প্রতি টন কাগজের দাম এক লাখ ৩৮ হাজার টাকার মতো। এর সঙ্গে ট্যাক্স-ভ্যাট আছে, ব্যাংক লোনের সুদ আছে; এই খরচ কে দেবে?
মার্চের আগে বই পৌঁছানো সম্ভব হবে না : আগামী মার্চের আগে সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন পাঠ্যবই পৌঁছানো সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি জানান, দেশীয় ছাপাখানায় সব বই মুদ্রণ, পরিমার্জন, বইয়ের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হওয়ায় এ দেরি হচ্ছে। গত ৮ জানুয়ারি সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা এ তথ্য জানান।
বিগত সময়ে মার্চের আগে পুরোপুরি বই দেওয়া হয়নি জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, আমরা (বই ছাপা) কার্যক্রম শুরু করেছি দেরিতে। আমাদের বই পরিমার্জন করতে হয়েছে। বইয়ের সিলেবাস, কারিকুলাম নতুন করে করতে হয়েছে। বইয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বিদেশে কোনো বই ছাপানো হচ্ছে না জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, দেশের সক্ষমতা কত, সেটা এবারই প্রথম দেখা যাচ্ছে। এতে তো দেরি হবেই।
ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, দেশীয় ছাপাখানায় সব বই মুদ্রণ, পরিমার্জন, বইয়ের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি থাকাসহ বিভিন্ন কারণেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, সব গোডাউন যেখানে আর্ট পেপারগুলো জমা ছিল, সেগুলো সব উদ্ধার করার পরও দেখা গেল যে দেশের ভেতর আপাতত কিছু ঘাটতি আছে। (আর্ট পেপার নিয়ে) বিদেশ থেকে জাহাজ রওনা হয়ে গেছে। কবে নাগাদ সব শিক্ষার্থী বই পাবে, জানতে চাইলে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, কবে নাগাদ সবাই সব বই পাবে, এটা আমি বলতে পারব না।
ফেব্রুয়ারিতেই সবাই বই পাবে : আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সবার হাতে নতুন বই দেওয়া হবে বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন। গত ৯ জানুয়ারি ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।
শফিকুল আলম বলেন, আজকের ক্যাবিনেট মিটিংয়ের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ক্যাবিনেটে বলা হয়েছে যে, আগামী মাসের মধ্যে সবার হাতে পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হবে। তিনি বলেন, আরেকটা বিষয় যে বিগত সরকার পাঠ্যপুস্তক উৎসব করত একদিনের জন্য। আসলে আমরা যে তথ্য পেয়েছি সেখানে দেখেছি যে আগেও বেশিরভাগ সময় বই বিতরণ শেষ করতে করতে মার্চ কিংবা জুলাই পর্যন্ত লেগে গেছে। ২০২২ সালে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের সবশেষ তারিখ ছিল ২৪ মার্চ, ২০২৩ সালে ১৭ মার্চ ও গত বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়েছে।
বইয়ের পিডিএফ থেকে প্রিন্ট এবং গাইড বই খুঁজছে শিক্ষার্থীরা : বইয়ের পিডিএফ থেকে প্রিন্ট করে পাঠ নিচ্ছেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীদের হাতে বই না পৌঁছালেও বাজার সয়লাব গাইড বইয়ে। গতকাল সরজমিন রাজধানীর নীলক্ষেত ও মিরপুর-১০ নম্বর বই বাজারে ঘুরে দেখা যায়, দোকানে দোকানে গাইড বই বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পাঠ্য বই শিক্ষার্থীদের হাতে না পৌঁছায় গাইড-বই বিক্রি বেশি হচ্ছে। অনেকেই আসছেন পাঠ্য বই কেনার উদ্দেশ্যে। না পেয়ে গাইড বই কিনছেন। আবার অনেকে পুরনো বইও কিনছেন। নীলক্ষেত্রে পাঠ্যবই কিনতে আসা আরিফুর রহমান বলেন, তার মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বই এখনো মেলেনি। এদিকে স্কুলে ক্লাস ও প্রাইভেট শুরু হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে গাইড বই কেনেন।
মিরপুর-১০ নম্বরেও একই চিত্র দেখা যায়। সেখানেও বিক্রি হচ্ছে গাইড বই। এনসিটিবি’র অনলাইনে প্রকাশ করা পাঠ্য বই ফটোকপি করে অধ্যায়ভিত্তিক বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে শুরুর দিকে অধ্যায়গুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে। আবার বাজারের একের ভেতর সব নামে বেশ কিছু গাইড-বই পাওয়া যাচ্ছে। সপ্তম শ্রেণির একের ভেতর সব গাইড বইয়ের দাম রাখা হচ্ছে ৭৩০ থেকে ৭৫০ টাকা। এগুলো আলাদা আলাদাভাবে কিনলে লাগছে এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা। সবুজ মিয়া নামে এক ব্যবসায়ী জানান, গাইড বই ঠেকাতে মোবাইল কোর্ট বসানোর ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই বইগুলো লুকিয়ে রাখেন তারা।
মন্তব্য