শেষ পর্যন্ত একই সুরে বিএনপি-জামায়াত

এম. সাইফুল ইসলাম
শেষ পর্যন্ত একই সুরে বিএনপি-জামায়াত

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রশ্নে মাঠে নানা বক্তব্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত একই সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা। গত কয়েকদিনে দল দুটির শীর্ষ নেতারা মৌলিক সংস্কার কাজ দ্রুত শেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন মাঠের আন্দোলনে যুক্ত প্রধান দুটি দলের নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে - তারা একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর সংগ্রাম করেছেন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের মানুষ এখন নির্বাচন দেখতে চায়। তবে, নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের কাজও শেষ করা জরুরি বলে মনে করছেন তারা।

বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে - সংস্কার দরকার। তবে, সংস্কারের জন্য দীর্ঘ সময় নিলে দেশে যে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে তা আরো বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। যার সুযোগ নিতে পারে পতিত আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা। গণঅভ্যূত্থানে স্পিরিট বজায় রেখে পতিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যের জোর দিচ্ছেন তারা।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছে বিএনপি ও জামায়াত। মাঝে মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হলেও তা বড় ধরণের কোনো প্রভাব পড়েনি দল দুটির সম্পর্ক বা জাতীয় কোনো ইস্যুতে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে। এবারের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করা দল দুটির মধ্যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই দল দুটির মধ্যে অনৈক্য দেখা দেয়। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে স্পষ্ট বিভাজন দেখা দেয়। জামায়াতের আমির বলেছিলেন, একটি কার্যকর সংস্কার করতে হলে সরকারকে সময় দিতে হবে। আর বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য ছিল সংস্কারের নামে বেশি সময় নিলে তৃতীয় পক্ষ কেউ সুযোগ নিতে পারে। এই ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা বেশিরভাগ সভা-সমাবেশে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ বা অপসারণ ইস্যুতে দলটি প্রকাশ্যে মত বিরোধে জড়িয়েছে। বিএনপি সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টির বিষয়টি সামনে এনে রাষ্ট্রপতি পদে শূন্যতা চায়নি। দলটির বক্তব্য ছিল, সর্বোচ্চ এই পদে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হলে ফের ১/১১-এর পরিস্থিতিসহ নানা আশঙ্কা রয়েছে। আর জামায়াত বলছে, বর্তমান রাষ্ট্রপতি শেখ হাসিনার মতোই স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্টের সহযোগী। শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি মর্মে রাষ্ট্রপতি যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাতে তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি সুযোগ পেলে যেকোনো সময় বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারেন। তাই জামায়াত তার পদত্যাগ চেয়েছে। এছাড়া জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র নিয়েও দল দুটির অবস্থান ছিল বিপরীতমুখী। তবে মাঠে নানা বক্তব্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত দল দুটির নেতারা ফের একই সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন।

২৫ জানুয়ারি শনিবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বলেছেন, বিএনপি সংস্কার এবং নির্বাচন-দুটির পক্ষেই। দুটিই জরুরি। সংস্কার নাকি নির্বাচন - কেউ কেউ এমন উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রশ্ন নিয়ে কূটতর্ক করার অপচেষ্টা করেছে। তারেক রহমান দেশের জনগণের চাহিদা তুলে ধরে বলেন, আমরা যদি দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি দেখি, সেটা কিন্তু ভিন্ন। দেশের কোটি কোটি পরিবারের কাছে এই মুহূর্তে নির্বাচন এবং সংস্কারের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সংসার পরিচালনা করা। তিনি বলেন, একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অপরদিকে জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া ভ্যাটের বোঝা। ফলে দেশের কৃষক শ্রমিক দিনমজুর, স্বল্প আয়ের, এমনকি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর কাছেও সংসার টেকানোই অনেকক্ষেত্রে দায় হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবারে চলছে নীরব হাহাকার। এই অবস্থার উত্তোরণে নির্বাচনের বিকল্প নেই।

এছাড়া প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো কর্মসূচিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যোগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত ভোট চাইছেন। তিনি কয়েকদিনে আগে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন জুলাই-আগস্টের মধ্যে ভোট করা সম্ভব। গত শনিবার ভোলায় জেলা জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলনে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সংস্কারের জন্য আমরা আরো ৬ মাস দিতে চাই। প্রশাসনে এখনও ফ্যাসিস্ট সরকারের কর্মকর্তারা আছেন, তাদের উৎখাত করে, যৌক্তিক সংস্কার করে জনমত গঠনের মধ্য দিয়ে ঐক্যের নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। যারা বলেন সংস্কার প্রয়োজন নেই নির্বাচন চাই, তাদের কথায় কিছু গন্ধ পাওয়া যায়।

এছাড়া ৩ জানুয়ারি নাটোরে কর্মিসভায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান জরুরিভাবে সংস্কার কাজ শেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অতি জরুরি সংস্কার কাজ শেষ করে সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে আপনাদের জায়গায় ফিরে যান। এ নির্বাচনে জনগণ যার ওপরে আস্থা রাখবে, যাদের ভোট দিলে দেশের মানুষকে সম্মান করবে, দেশের মানুষকে ভালোবাসবে তাকে ভোট দেবে।

এছাড়া গত ২৪ জানুয়ারি কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন, সব দলকে স্বাধীন সার্বভৌম প্রশ্নে এক কাতারে এসে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচনের আগে সংস্কার জরুরি। সংস্কারের নামে নির্বাচন নিয়ে কালক্ষেপণ জনগণ মেনে নেবে না। ডা. তাহের বলেন, গণহত্যার বিচার করতে হবে। সরকারকে বলে দিতে চাই তালবাহানা নয়, কোনো সময়ক্ষেপণ নয়, অনতিবিলম্বে এই খুনিদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধরী গতকালও জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নির্বাচন বিলম্ব করার কোনো সুযোগ নেই। জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া গণতন্ত্রের অগ্রগতির সুযোগ নেই। অগ্রগতির জন্য নির্বাচন ছাড়া আর কোনো পথ নেই। অন্য কোনো পথ খুঁজতে গেলে জনমনে সন্দেহের উদ্বেগ হবে। এতে জনগণ হতাশ হবে, গণতন্ত্র আবারও মুখ থুবড়ে পড়বে। আমির খসরু বলেন, দেশের মালিকানা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে বিদায় করেছে তারা। সুতরাং এই দেশের জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ কীভাবে পরিচালিত চলবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব সংসদ গঠন করতে হবে। এর ব্যতিক্রম কিছু করার সুযোগ নেই।

বিষয়টি নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, আসলে বিএনপি ও জামায়াতে অনৈক্য সৃষ্টি হলে ফ্যাসিবাদীরা সুযোগ নিতে পারে। তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকার উপরে জোর দিচ্ছি। তিনি বলেন, তেমন কোনো মনোমানিল্য এখন আর দেখছি না। দুই দলই চাইছে ঐক্য। তিনি আরো বলেন, ঐক্য না থাকলে এখানে আবারো ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় আধিপত্য নতুন করে বিস্তার লাভ করতে পারে।

এ বিষেেয় জামায়াতের ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই আমরা ঐক্যবব্ধ আছি। আগামীতেও দেশ ও জাতির স্বার্থে বিএনপি-জামায়াত এক থাকবে ইনশাআল্লাহ। মাঠের কথাবার্তা যাই হোক না কেন দুই দলের মৌলিক চাওয়া এক।

জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে এককাতারে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করে জামায়াত। পরে ক্ষমতায় এসে জামায়াতকে নিধনে নামে আওয়ামী লীগ। পরে ফের আওয়ামী লীগ ঠেকাতে ১৯৯৯ সালে বিএনপি-জামায়াত নিয়ে চারদলীয় জোট হয়। ২০০১ সালে জোটবদ্ধ নির্বাচন করে সরকার গঠন করে দল দুটি। সম্পর্কে উত্থান-পতন হলেও জোট ভাঙেনি।

২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ আন্দোলন করে বিএনপি ও জামায়াত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিবন্ধন হারানো জামায়াতের নেতারা বিএনপির প্রতীকে প্রার্থী হন। ২০২২ সালে দুদল আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ভেঙে দিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে নামে। প্রথম দিকে জামায়াত যুগপৎ আন্দোলনে থাকলেও মাঝে কিছু সময় নানা অভিযোগ এনে জামায়াত সেখান থেকে সরে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে ফের ২০২৪ এর নির্বাচনে আগে ও পরে বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে একই ধরনের কর্মসূচি পালন করে জামায়াত। গত জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার গণহত্যা চালায়। বিএনপি ও জামায়াতকে আন্দোলনের জন্য দায়ী করে ঢালাও মামলা এবং গ্রেপ্তার করে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে তাড়াতে গতবছর ২৬ জুলাই সকল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয় বিএনপি। এবিষয়ে বিএনপি থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমরা বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে সব শরিক দল ও জোট, বাম-ডান সব রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক ও সব ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের প্রতিও জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছি।’ ওই ডাকে ওই আন্দোলনে সর্বোচ্চভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠে ছিল দল দুটি।

মন্তব্য