ত্রিশ ঘণ্টা পর গতকাল বুধবার (২৯ জানুয়ারি) ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে শিডিউল বিপর্যয়ে পড়েছে কমলাপুর থেকে ছাড়া যাওয়া বেশিরভাগ ট্রেন। দেশের অন্যান্য স্টেশনেও একই পরিস্থিতি ছিল। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। এক-দেড় ঘণ্টা, এমনকি সর্বোচ্চ চার ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে ছেড়েছে ট্রেন। পুরোদমে কার্যক্রম চালু করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে দুই থেকে তিন দিন লাগতে পারে বলে জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। কর্মবিরতিতে ৩০ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় কমলাপুর স্টেশনের এক কোটি ২০ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে রেল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে।
গতকাল বুধবার (২৯ জানুয়ারি) সরেজমিন কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে যাত্রীদের করুণ অবস্থা দেখা গেছে। কথা হয় শাহজাহান নামের এক যাত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ট্রেন চলাচল শুরু হলেও শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। তারপরও স্বস্তির খবর ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে, এটা স্বাভাবিক থাকলেই আমরা যাত্রীরা খুশি।
সেলিম মাহমুদ নামের আরেক যাত্রী বলেন, আমি জামালপুর যাওয়ার জন্য স্টেশনে এসেছি। তবে শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে প্রায় এক ঘণ্টা স্টেশনে বসে থাকতে হয়েছে। আমার মতো বহু যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েছেন। তবে আশা করছি, এই ভোগান্তি দ্রুত নিরসন হবে।
চট্টগ্রামের একটি কলেজের শিক্ষক লিয়াকত আলী বলেন, তিনি পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামে যাওযার টিকিট কেটেছেন। এ জন্য সুবর্ণ এক্সপ্রেসের টিকিট কেটেছিলেন। পরিবার নিয়ে শেষ পর্যন্ত ট্রেনে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন।
ট্রেনের সূচি বিপর্যয়ে ভোগান্তির কথা জানিয়ে চট্টলা এক্সপ্রেসের যাত্রী শফিক রহমান বলেন, চট্টগ্রামে জরুরি কাজ আছে। আদৌ যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। মধ্যরাতের পর কর্মবিরতি প্রত্যাহারের খবর শুনেছেন। এরপর ভোরে তাড়াহুড়ো করে প্রস্তুতি নিয়ে স্টেশনে চলে আসেন। কিন্তু এসে দেখেন, ট্রেন ঠিক সময়ে ছাড়ছে না।
ময়মনসিংহগামী ট্রেনের যাত্রী মোমেনা বেগম জানান, ট্রেনের অপেক্ষায় প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে বসে থাকলেও কোনো খবর নেই। কখন আসবে তা বলতে পারেন না স্টেশন মাস্টার।
কমলাপুর স্টেশনে যাত্রীদের দীর্ঘ অপেক্ষার দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। সিলেটগামী যাত্রী রাবেয়া বেগম বলেন, সকাল সাড়ে ৬টায় ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল। দেরি হবে জানার পর ৮টায় এসেছি, কিন্তু এখনো ট্রেন ছাড়েনি।
কক্সবাজারগামী যাত্রী মৌসুমী খন্দকার জানান, মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত জানতাম, কর্মবিরতি চলছে। গভীর রাতে প্রত্যাহারের খবর আমরা পাইনি। ফলে ট্রেন মিস করেছি। এখন আমাদের টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়া হোক।
সূচি বিপর্যয়ের চিত্র : ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্টেশন থেকে দৈনিক ভোরের আকাশ প্রতিবেদকদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-সিলেট রুটের পারাবাত এক্সপ্রেস সকাল সাড়ে ৬টায় ছাড়ার কথা থাকলেও বেলা ১০টায়ও ছাড়েনি। একইভাবে জয়দেবপুর কমিউটার, ধূমকেতু এক্সপ্রেস, তিস্তা এক্সপ্রেসসহ বেশ কয়েকটি ট্রেন নির্ধারিত সময়ের এক থেকে তিন ঘণ্টা পর ছেড়েছে।
কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন জানান, সকাল ৬টা ৩০ মিনিট থেকে অনেক ট্রেন ছেড়ে গেছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি ট্রেন শিডিউল থেকে বিপর্যয় হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হয়েছে সিলেটগামী পারাবাত এক্সপ্রেস এর ক্ষেত্রে। এই ট্রেনটি প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা দেরি করতে হয়েছে।
ময়মনসিংহ স্টেশন থেকেও বেশ কিছু ট্রেন সূচি বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে ছেড়েছে। যাত্রী শফিকুল ইসলাম বলেন, ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ায় স্বস্তি পেয়েছি। তবে প্রত্যেকটি ট্রেন ৩০-৪০ মিনিট দেরিতে আসছে।
চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে সকালে প্রথম ট্রেন ছাড়ার কথা সকাল ছয়টায়। ঢাকাগামী চট্টলা এক্সপ্রেস নামের এই ট্রেন ছেড়েছে ২ ঘণ্টা ১০ মিনিট দেরিতে সকাল ৮টা ১০ মিনিটে। সকাল সাড়ে সাতটায় সুবর্ণ এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা থাকলেও ছেড়েছে ৯টা ১০ মিনিটে। দেড় ঘণ্টা দেরিতে সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে ছেড়েছে সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস। কক্সবাজার ঈদ স্পেশাল সকাল সাতটায় চট্টগ্রাম স্টেশন ছাড়ার কথা থাকলেও ছাড়েনি। এ ছাড়া ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী কক্সবাজার এক্সপ্রেস ও পর্যটক এক্সপ্রেস সকালে চট্টগ্রাম স্টেশনে আসেনি।
চট্টগ্রাম স্টেশন ব্যবস্থাপক আবু বক্কর সিদ্দিক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাত আড়াইটায় কর্মবিরতি প্রত্যাহারের বিষয়টি তারা জানতে পারেন। তবে লোকোমাস্টাররা (চালক) এসেছেন সকাল ছয়টার পর। তাই ট্রেনের সার্বিক প্রস্তুতি যথাসময়ে নেওয়া যায়নি। এ জন্য সকালে সূচি মেনে ট্রেন চালানো সম্ভব হয়নি। তবে বিকেলের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে তিনি আশাবাদী। আবু বক্কর সিদ্দিক আরও বলেন, আজ (গতকাল) ১১টি আন্তনগর ট্রেন চট্টগ্রাম স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার কথা। কিছুটা বিলম্ব হলেও কোনো ট্রেনেরই যাত্রা বাতিল করা হচ্ছে না।
চট্টগ্রামের একটি কলেজের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকায় যাবেন। এ জন্য সুবর্ণ এক্সপ্রেসের টিকিট কেটেছিলেন। পরিবার নিয়ে শেষ পর্যন্ত ট্রেনে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। কিছুটা দেরি হলেও যেতে পেরে ভালো লাগছে।
একদিনে কমলাপুরে সোয়া কোটি টাকার ক্ষতি : রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতিতে প্রায় ৩০ ঘণ্টা ট্রেন বন্ধ থাকায় রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনের প্রায় সোয়া কোটি টাকার মতো আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কমলাপুর স্টেশনের ব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন গতকাল সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কমলাপুর স্টেশনের টিকিট বিক্রি থেকে দৈনিক ১ কোটি ১৫ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা আয় হয়। তো কাল যেহেতু সবগুলো ট্রেন বন্ধ ছিল সে কারণে টিকিটের টাকা যাত্রীদের ফেরত দিতে হয়েছে। ফলে রেলের ওই টাকাটা ক্ষতি হয়েছে।’
অবরোধ ও সমাধান : দাবি পূরণের আশ্বাসের পর গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান মঙ্গলবার রাত আড়াইটার দিকে রেলওয়ে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
এর আগে গত সোমবার মধ্যরাতের পর থেকেই বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে সারাদেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন রেলপথে চলাচলকারী সাধারণ যাত্রীরা।
মন্তব্য