টানা সাড়ে ১৫ বছর পর প্রায় ৬ মাস ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দলটির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। কেন্দ্রীয় নেতাদের অধিকাংশের নামে মামলা করা হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। বাকিরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দেশের বাইরে চলে গেছেন অনেকে। এ অবস্থায় ফের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে দলটি। এরই মধ্যে হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। এ কর্মসূচি ফল করতে অনলাইনে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এদিকে, কর্মসূচির প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, জনগণের প্রতিক্রিয়া জানতেই দলটি এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। গণআন্দোলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ছাত্র সমন্বয়করা বলছেন, আওয়ামী লীগকে মাঠে নামতে দেওয়া হবে না। বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল বলছে, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের হাত থেকে ছাত্র-জনতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার তাদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে ছাত্রজনতা জুলাই-আগস্টের মতোই আবারও রাজপথে নেমে ছাত্রলীগকে প্রতিরোধ করবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ যত দিন না ক্ষমা চাচ্ছে, যত দিন না তাদের নেতৃত্বকে বিচারের মধ্যে আনা হচ্ছে এবং যত দিন না জবাবদিহির মধ্যে আসছে, তত দিন তাদের কোনো প্রোটেস্ট (প্রতিবাদ কর্মসূচি) করতে দেয়া হবে না।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেশিরভাগ এলাকাছাড়া। ফলে তাদের কার্যক্রম হয়ে পড়েছে অনলাইন ভিত্তিক। দলটির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ, টেলিগ্রাম চ্যানেলসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে নানাবিধ পোস্ট আর ভিডিও বার্তা দিয়ে কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা চলছে। ৫ আগস্টের আগে দলটির বক্তব্য-বিবৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বিএনপি-জামায়াত। এখন সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে। পলাতক বিভিন্ন নেতা অনলাইনে ভিডিও বার্তা আর টকশো করে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজসহ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত পোস্ট, ফটোকার্ড, ভিডিও, বার্তা আপলোড করা হচ্ছে। এতে দলের নেতাকর্মী ও গণমাধ্যমকে উদ্দেশ করে নানা নির্দেশনা ও বার্তা দেওয়া হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, অগ্নিকাণ্ড, ভাঙচুরের আপডেট দেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত অন্তর্বর্তী সরকারের নেতিবাচক এবং আওয়ামী লীগের ইতিবাচক নানা খবরও শেয়ার করা হচ্ছে। এছাড়া মাঝে মধ্যেই দলীয় প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অডিও বার্তা প্রচার করা হচ্ছে। গত ২৮ জানুয়ারি ‘জুলাই জুলুমের সংকট, প্রতিরোধের পথ’ শীর্ষক একটি টকশো প্রচারিত হয়। সেখানে অতিথি ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মী রোকেয়া প্রাচী এবং সমাজকর্মী ও প্রগতিশীল অ্যাক্টিভিস্ট আফসানা কিশোয়ার। এ রকম আরও একটি আলোচনায় যুক্ত ছিলেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। নেতাকর্মীদেরও সরাসরি আলোচনায় নিয়ে আসার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এজন্য তারা নেতাকর্মীদের ই-মেইলে যোগাযোগের আহ্বান জানিয়েছে। সেখানে কথা বলছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানক, অল ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ সভাপতি নজরুল ইসলাম, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ তৃণমূল পর্যায়ের অনেক কর্মীও। এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ডে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কর্মসূচিতে অনলাইন ব্যবহার করেই বক্তব্য রেখেছেন।
কর্মসূচি : এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর এটি দলের প্রথম আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি। কর্মসূচি প্রসঙ্গে বলা হয়, অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকারের অপশাসন-নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদ, দেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও দখলদার ফ্যাসিস্ট ইউনূসের পদত্যাগ দাবিতে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি লিফলেট বা প্রচারপত্র বিলি; ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ; ১০ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ; ১৬ ফেব্রুয়ারি অবরোধ কর্মসূচি এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক কঠোর হরতাল পালন করা হবে।
যা বলছেন রিজভী : আওয়ামী লীগের ডাকা হরতাল প্রসঙ্গে বিএনপির জ্যেষ্ঠ সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, হরতালের ডাক দিলেন আর মানুষ লাফ দিয়ে পড়বে- এমনটা হবে না। বরং মানুষ আপনাদের শাস্তির জন্য অপেক্ষা করছে। জনগণের প্রতিক্রিয়া জানতেই এই হরতাল আহ্বান করা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে তিনি বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবে নিহত-আহতরা বিচার চায়। আহনাফের মতো ছেলেকে যারা গুলি করেছে, তাদের আত্মা রক্তপিপাসু নেকড়ের আত্মা। শেখ হাসিনার কাছে নারী-শিশুর কোনো মূল্য নেই, একটাই মূল্য সিংহাসন। তিনি কতজনকে সন্তানহারা করেছে হদিস নেই। গুলি ছিল শেখ হাসিনার কাছে একটা খেলা। ক্রসফায়ার ছিল আনন্দের বিষয়। বিরোধী পক্ষের লাশ দেখলে খুশি হতেন হাসিনা। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ এক নারী। তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরে বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও পদক্ষেপ দেখি না। যারা আহনাফ, আবু সাঈদ, মুগ্ধকে হত্যা করেছে তারা আইনের লোক। তাদেরকে কারা আইনের হাত থেকে রক্ষা করছে? সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকেই বাদী হয়ে মামলা করা উচিত।
প্রতিহতের ঘোষণা : আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মাঠে নামলে তাদের প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রদলসহ বিরোধীরা। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেছেন, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের হাত থেকে ছাত্র-জনতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার তাদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে ছাত্রজনতা জুলাই-আগস্টের মতোই আবারও রাজপথে নেমে ছাত্রলীগকে প্রতিরোধ করবে।
ফেসবুক পেজে নাছির বলেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে যে দুই হাজারের অধিক মুক্তিকামী মানুষ শহীদ হয়েছে, তাদের সবাইকে পুলিশ বা সরকারি বাহিনী হত্যা করেনি। নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের ক্যাডাররা প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে অসংখ্য মানুষ খুন করেছে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন গণহত্যায় ফ্যাসিস্ট পলাতক খুনি হাসিনার নির্দেশে কসাই-জল্লাদের ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রলীগ। গণহত্যার আগেও সারাদেশে বিশ্বজিৎ-আবরার থেকে শুরু করে ছাত্রলীগ যত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, সবগুলো নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন মিলেও এত মানুষ খুন করেনি। তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্রলীগকে নামে মাত্র নিষিদ্ধ করে দায় সেরেছে। ছাত্রলীগের খুনি, সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনার কোনো জোরালো তৎপরতা গ্রহণ করেনি। ছাত্রলীগের শীর্ষ কোনো নেতাকে বা সন্ত্রাসী ক্যাডারকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ছাত্রজনতা নিজেরা কয়েকজনকে আইনের হাতে তুলে দিয়েছে। সরকারের এই ব্যর্থতার কারণেই নিষিদ্ধ খুনি সংগঠন ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করার সাহস পেয়েছে। খুনিদের বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের নির্লিপ্ত আচরণের কারণেই তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাচ্ছে। গণহত্যা, হত্যাকাণ্ড এবং দুর্নীতির জন্য ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে বিক্ষোভ করতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম। গত বুধবার নিজের ফেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে তিনি লেখেন, যতক্ষণ না আওয়ামী লীগ এই গণহত্যা, হত্যাকাণ্ড এবং দুর্নীতির জন্য ক্ষমা না চায়, যতক্ষণ না তার নেতাকর্মীরদের বিচার না হয় এবং যতক্ষণ না আওয়ামী লীগ তার বর্তমান নেতৃত্ব এবং ফ্যাসিবাদী আদর্শ থেকে নিজেকে আলাদা করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিক্ষোভ করার কোনও সুযোগ নেই।
কর্মসূচি পালনের নামে আওয়ামী লীগ মাঠে নামার চেষ্টা করলে সেটি প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেছেন, তারা যদি আবার এখানে এসে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে, কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করার চেষ্টা করে, তাহলে এদেশের মানুষই তাদের প্রতিহত করবে।
জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের এই প্ল্যাটফর্মটি গত কয়েক মাস ধরেই বলে আসছে, শেখ হাসিনাসহ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলটিকে তারা রাজনীতি করতে দেবেন না।
নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মসূচির বিরুদ্ধে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’র ব্যানারে গত বুধবার রাত ১০টার দিকে এ কর্মসূচি পালিত হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় এসে শেষ হয়। পরে সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
মন্তব্য