জাতীয় সংসদ নির্বাচন নাকি স্থানীয় নির্বাচন-কোনটি আগে হবে তা ফের আলোচনায়। গত কয়েক মাস ধরেই থেমে থেমে বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা। বিচ্ছিন্নভাবে এতদিন আলোচনা হলেও গতকাল সোমবার জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টার বক্তব্যের পর বিষয়টি আবার ব্যাপক আলোচনায় চলে এসেছে। এর আগে বিভিন্ন সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটির একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তির বক্তব্য এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর জরিপ প্রতিবেদনও গেছে আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে। অপরদিকে স্থানীয় সরকারের আগে জাতীয় নির্বাচন চায় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আর সরকার জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়ে রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফলে কোন নির্বাচন আগে হবে তা জানার আগ্রহে সংশ্লিষ্টদের দিকে তাকিয়ে দেশের জনগণ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে মন্তব্যের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এমনিতে রাজনৈতিক দলগুলো এবং জনগণের একাংশের মধ্যে আগে থেকেই সন্দেহ-সংশয় রয়েছেÑ অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে চায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রসঙ্গটি আসায় সেই সন্দেহ-সংশয় আরও পরিপুষ্ট হয়েছে। কেননা এ সরকারের উদ্যোগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে হলে তা জাতীয় নির্বাচনের আগেই করতে হবে। জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেলে তখন আর তাদের হাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের সময় থাকবে না। তখন বিজয়ী দলের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সন্দেহের আরেকটি বড় কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা। জনমনে এমন একটা ধারণা আছে, প্রকাশ্যে না হলেও ছাত্র-তরুণরা দল গঠনের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। আর জাতীয় নির্বাচনের আগে দল গোছানোর জন্য এদের কিছুটা সময় প্রয়োজন। এসব কারণে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার একটি প্রচেষ্টা থাকলেও থাকতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বের মধ্যে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি যুক্ত করা যায়, তবে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করা অনেকটা সহজ হয়ে যায় বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সংসদের আগে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে : উপদেষ্টা আসিফ
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনার মধ্যে আগে আলোচনায় আসে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। তাই এ নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।গতকাল সোমবার দুপুরে নগর ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে এ কথা জানান তিনি।
সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় জাতীয় নাগরিক কমিটি
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করার মতো পরিস্থিতি আছে বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে সরকার তা শুরু করে যুগপৎভাবে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচন (প্রক্রিয়া) চালাতে পারে বলে মনে সংগঠনটি। গত ১১ জানুয়ারি রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য আলাউদ্দিন মোহাম্মদ এ কথা বলেন। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার কাঠামো একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি আছে বলে তারা দেখেছেন। জাতীয় নাগরিক কমিটিও মনে করে জাতীয় নির্বাচনের আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন তার সক্ষমতার পরিচয় দেবে। স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে আলাদা বিবেচনা করেই একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠন করার জন্যই নির্বাচন দরকার।
দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ আগে স্থানীয় নির্বাচন চায় : বিবিএস জরিপ
অতি সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন চান। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে গত ডিসেম্বর মাসের ২০ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশে জনমত জরিপ পরিচালনা করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে বিবিএসের মাধ্যমে এ জরিপ চালিয়েছে।জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের সব স্তরের নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছেন ৬৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ মানুষ। বিপরীতে ২৯ শতাংশ মানুষ জাতীয় নির্বাচনের পরেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় করার পক্ষে মত দিয়েছেন প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ। আর দলীয় প্রতীকে এই নির্বাচন করার কথা বলেছেন প্রায় ২৮ শতাংশ। অন্যদের এ বিষয়ে জবাব ছিল ‘না’ বা তারা ‘জানেন না’।
আগে জাতীয় নির্বাচন করার পক্ষে ইসি
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচন করার পক্ষে অবস্থান তুলে ধরেছে নির্বাচন কমিশন। সম্প্রতি ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রায় তিন ঘণ্টা সভা শেষে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আমাদের সামগ্রিক ফোকাস জাতীয় নির্বাচন। কমিশন জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকলে অপরাপর সকল প্রস্তুতিসম্পন্ন হয়ে যাবে। এমন কোনো ইভেন্ট আসা ঠিক হবে না যেটা জাতীয় নির্বাচন নির্বাচনকে ব্যহত করে।’তিনি আরও বলেন, ‘তবে আমাদের অবস্থান হচ্ছে মূলত ওই জায়গাটাতে বলছি, সব নির্বাচন একসঙ্গে করা সম্ভব নয়। সব স্থানীয় নির্বাচন একসঙ্গে করা সম্ভব নয়।’
আগে জাতীয় নির্বাচন চায় বিভিন্ন দল
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ সভায় এ বিষয়ে আলোচনার পর দলটির নীতিনির্ধারকেরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ১৩ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে দলীয় সিদ্ধান্ত জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা আগে সংসদ নির্বাচন চাই। আমাদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রশ্নই আসে না। কারণ, এখন তো পুরো দেশের, পুরো জাতির ফোকাসটা হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন হতে পারেনি। মানুষ সে জন্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র উত্তরণের পথটাকে পূরণ করতে চায়।’বিএনপি মনে করে, সরকারের দিক থেকে নানাভাবে জাতীয় নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টা রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রক্রিয়ার অংশ। সে জন্য দলটির নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েই এ ধরনের চিন্তার সমালোচনা করছেন। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির মহাসচিব তির্যক প্রশ্ন তোলেন, এ রকম ক্রিটিক্যাল সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া অন্য নির্বাচন করার চিন্তাটা আসে কোত্থেকে?জাতীয় সংসদ, নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে-এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি জামায়াতে ইসলামী। তাদের সাংগঠনিক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে বলেও জানা যায়নি। তবে দিনক্ষণ ঠিক না হলেও আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দলের নিবন্ধন ও দলীয় মার্কা ‘দাঁড়িপাল্লা’ ফিরে পাওয়ারও আশা করছে। নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের সাংগঠনিক অবস্থান শক্তিশালী করাসহ নানামুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে দলটি।আর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার একান্ত ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, সর্বাগ্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়াই ভালো। একটা নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, সে সরকার স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। এটা যদি না হয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় প্রার্থীদের পক্ষে-বিপক্ষে যে লড়াই শুরু হবে, সেটা অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।’বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘জরিপে কীভাবে প্রশ্ন করা হয়েছে, আমি জানি না। এ মুহূর্তে মানুষ বিক্ষুব্ধ আছে স্থানীয় সরকারের নাগরিকসেবা নিয়ে। সে কারণে কেউ কেউ এমনটা বলে থাকলে সেটাকে আমি সাধারণভাবেই দেখি। কিন্তু দেশের এখনকার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় নির্বাচনই আগে করা উচিত। সরকার নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারে কাজ করছে। আমি মনে করি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার করে তারপরই নির্বাচন করা উচিত হবে।’গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘গণতন্ত্র উত্তরণে কোনটা আগে কোনটা পরে, সেটা চিহ্নিত করতে হবে। নির্বাচনের আগে যে সংস্কারগুলো করা যাবে, সেগুলো শেষ করাই হচ্ছে এখনকার জাতীয় অগ্রাধিকার। আমরা মনে করি, সেদিকেই মনোযোগ বেশি থাকা দরকার। আর কোনো নির্বাচন আগে করতে হবে, সেটা অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’এ মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচনই মুখ্য মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন সব সময়েই ঝামেলার। এখন এ নির্বাচন করতে চাইলে আওয়ামী লীগের মুখচেনা দাগিরাও ঢুকে যাবেন। এতে এলাকাভিত্তিক গন্ডগোল হওয়ার আশঙ্কা আছে। এটা মোকাবিলার করার মতো যে ধরনের সরকার থাকতে হয়, এ সরকার সে রকম জনসম্পৃক্ত সরকার নয়। তাই আগে জাতীয় নির্বাচন হওয়াই উত্তম।
বেশির ভাগ মানুষ আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান : তোফায়েল আহমেদ
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, বেশির ভাগ মানুষ চান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এখনো সময় আছে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেবেন তারা।তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন বিভিন্ন ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২০০ দিনের বেশি সময় লাগে। বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়। এখন একই দিনে নির্বাচন করা হলে খরচ হবে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা। আর সময় লাগবে ৪৫ দিন। তাই একই দিনে নির্বাচন আয়োজনের চিন্তা রয়েছে।
ভোরের আকাশ/নিখি
মন্তব্য