-->

‘প্রবাসীর কথা’র নূরুল ইসলাম আর নেই, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শোক

কূটনৈতিক প্রতিবেদক
‘প্রবাসীর কথা’র নূরুল ইসলাম আর নেই, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শোক
নূরুল ইসলাম। ফাইল ছবি

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সমাজসেবক, সাংবাদিক ও ‘প্রবাসীর কথা’ গ্রন্থের লেখক নূরুল ইসলাম মারা গেছেন। গতকাল মঙ্গলবার ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তিনি লন্ডনের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৭ ডিসেম্বর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন নূরুল ইসলাম। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে এবং নাতি-নাতনি, আত্মীয় স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

দুঃসাহসী সাধক ও গবেষক নূরুল ইসলাম ‘প্রবাসীর কথা’ নামে সহস্রাধিক পৃষ্ঠার গবেষণা গ্রন্থ রচনা করে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এই বইয়ের লেখক হিসেবে ২০১২ সালে বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ পান।

নূরুল ইসলামের প্রবাসীর কথা গ্রন্থে প্রবাসের সুখ-দুঃখ, যাপিত জীবনের সুবিধা-অসুবিধা এবং দেশবাসীর কাছে চাওয়া-পাওয়ার কথা ফুটে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে বাঙালি জাতির সংগ্রাম গাঁথা জীবন কথা খুঁজে পেতে হলে এই গ্রন্থ প্রথম ও নির্ভরযোগ্য দলিল।

নূরুল ইসলাম ১৯৩২ সালের ১ জুন সিলেট সদর থানার সদরখলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সিলেট এমসি কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৫২-৫৩ সালে কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন।

ভাষা আন্দোলনেও অবদান রাখেন নূরুল ইসলাম। ঢাকায় আন্দোলনরত ছাত্রদের গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তৎকালীন গোবিন্দপার্কে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রথম সভায় সভাপতিত্ব করেন তিনি।

১৯৫৩-৫৪ সালে তিনি সিলেট মহকুমা (বর্তমান সিলেট জেলা) ছাত্র ইউনিয়নের (ইপসু) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে একনিষ্ঠভাবে কাজ করেন।

ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন যান নূরুল ইসলাম। লন্ডনে গিয়েই আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। নূরুল ইসলাম এই আন্দোলনে অংশ নিয়ে অল্পদিনে ছাত্র ও সুধী মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

১৯৬৩ সালে ‘ন্যাশনাল ফেডারেশন অব পাকিস্তান অ্যাসোসিয়েশন ইন গ্রেট ব্রিটেন’ গঠনের অন্যতম প্রধান ছিলেন তিনি। পরের বছর ১৯৬৪ সালে ‘ইস্ট পাকিন্তান হাউস’ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন।

আন্তর্জাতিক প্রচার তৎপরতার কৌশল নির্ধারণের জন্য বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য ১৯৬৬ সালে দেশে ফেরেন নূরুল ইসলাম। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতার নামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেপ্তার ও তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে। ফলে যথাসময়ে লন্ডনে ফিরতে পারেননি। এতে লেখাপড়ার ব্যত্যয় ঘটে।

লেখক ও গবেষক নূরুল ইসলাম তখন দেশ থেকে ৬-দফা আন্দোলনের পক্ষে প্রচার তৎপরতায় সক্রিয় হন। তিনি ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে ৪ ও ৫ নং সেক্টরের প্রতিনিধি দেওয়ান ফরিদ গাজীর (প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা সম্পন্ন) একান্ত সচিব ছিলেন নূরুল ইসলাম।

১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের কর্মসূচির অংশ হিসেবে বর্হিবিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হন তিনি। বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি আব্দুস সামাদ আজাদের সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফরও করেন।

স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রাপ্তির জন্য ইউরোপীয় বন্ধুদের মাধ্যমে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছেন নূরুল ইসলাম।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবাসীদের কল্যাণার্থে প্রবাসী বাঙালি কল্যাণ বোর্ড’ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন হিসেবে প্রবাসী অন্তপ্রাণ নূরুল ইসলাম এই বোর্ডের সচিব হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সব কাজ সম্পাদন করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শোক

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বুধবার (১২ জানুয়ারি) এক বার্তায় নূরুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। শোক বার্তায় তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর সিলেটে এক সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নূরুল ইসলাম অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। প্রবাসে থেকেও তিনি সবসময় বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণে কাজ করতেন। তার অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

মন্তব্য

Beta version