-->
মোটরসাইকেল

বিদেশে নিষিদ্ধ, দেশে বছরে বিক্রি পাঁচ লাখ

১৫ লাখ চালকের লাইসেন্স নেই

রাজন ভট্টাচার্য
বিদেশে নিষিদ্ধ, দেশে বছরে বিক্রি পাঁচ লাখ
বাংলাদেশে বছরে পাঁচ লাখের বেশি মোটরসাইল বেশি বিক্রি হচ্ছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গাড়ি উৎপাদনকারী দেশ জাপানে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে মোটরসাইকেল ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্যান্য উন্নত দেশের শহরগুলোতে একই কারণে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

কিন্তু নিষিদ্ধ দেশগুলো নানা কায়দায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই নিষিদ্ধ যান বিক্রির উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বছরে পাঁচ লাখের বেশি মোটরসাইল বেশি বিক্রি হচ্ছে।

নিবন্ধিত যানের প্রায় ৭০ ভাগই এখন মৃত্যুদূত এই যানটি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৩৩ লাখ মোটরসাইকেলের মধ্যে ১৫ লাখ চালকের লাইসেন্স নেই!

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেল ৪ চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া ট্রাফিক আইন না মানা, বেপরোয়া মানসিকতা, তারুণ্য দেখানো, রাজনৈতিক কারণসহ অন্তত ১০ কারণে দুর্ঘটনার মাত্রা বাড়ছে।

মৃতদের একটা বড় অংশ বয়সে তরুণ। তরুণ সমাজের এই মৃত্যু ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে বড় বাধা হতে পারে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে মোটরসাইকেল বৃদ্ধির হ্রাস টেনে ধরার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে অন্য সব রকম যানবাহন মিলিয়ে যে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু হয়েছে মোটরসাইকেলেই এর সমান হয়েছে। ২০২১ সালে এ দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ ভাগের বেশি। তিন বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা দেশে মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের বেশি।

অন্যান্য বাহনের সমান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, গত তিন বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ছাড়া অন্যান্য দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় সমান।

মূলত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ার কারণে ২০২১ সালে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মোট সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫১ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার সমস্যাটি রাজনৈতিক। কারিগরিভাবে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না। এত বিশৃঙ্খল-উচ্ছৃঙ্খল সড়কব্যবস্থা চাইলেই আধুনিক, নিরাপদ করা সম্ভব না। যারা সড়কে বিশৃঙ্খলার সুবিধাভোগী, তারাই নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন কমিটিতে বসে আছেন।

কেন বাড়ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা

অন্যান্য যানবাহনের চেয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কেন এত বাড়ছে- এ প্রশ্ন ওঠা এখন খুবই স্বাভাবিক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোর ও যুবক।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বৃদ্ধির জন্য ট্রাফিক আইন না জানা এবং না মানার বিষয়টি প্রবল। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় মোটরসাইকেল সংস্কৃতি চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মোটরসাইকেল চালক সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়াভাবে চলাচল করছে। এদের বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারী নিহতের ঘটনাও বাড়ছে।

জানতে চাইলে বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘দুর্ঘটনার বাহন হিসেবে গোটা দুনিয়ায় এখন মোটরসাইকেল পরিচিত। তাই এই মৃত্যু যানের বিকল্প ভাবা উচিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের দেশে মানুষ না বুঝেই দ্রুত চলাচলের জন্য মোটরসাইকেল কিনছেন।’

অন্য সংগঠন যা বলছে

যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সেভ দ্য রোড বলছে, সংগঠিত দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৩৩ শতাংশ বাস, ৩৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ ট্রাক, পিকআপ কাভার্ডভ্যান-লরি, ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ কার-মাইক্রো, ৩ দশমিক ১২ শতাংশ অটোরিকশা, ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ নছিমন-করিমন ও ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ ব্যাটারি চালিত রিকশা ও ইজিবাইক- এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

তিনি বলেন, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গাড়ি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে।

পাশাপাশি আইন না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি ও গণপরিবহণ খাতে চাঁদাবাজি দুর্ঘটনাকে উৎসাহিত করে যাচ্ছে।

সংকট সমাধানে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে। বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি, পরিবহণ মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি, সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, গণপরিবহণে চাঁদাবাজি বন্ধ, রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিশ্বের উন্নত শহরে যখন দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা হয়েছে তখন আমাদের দেশে এই যানটি বেশি বিক্রি হচ্ছে। এ বিষয়টি আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।’

তিনি বলেন, দুর্ঘটনা রোধে টেকসই পরিবহণ কৌশল প্রণয়ন ও সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ৩৩ লাখ

দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের প্রায় ৭০ শতাংশই মোটরসাইকেল। বিআরটিএ বলছে, নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪৯০টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেলই ৩৩ লাখ ৭৬ হাজার ২১৪টি।

ঢাকায় আছে ১৭ লাখ ৩৩ হাজার ১৯৩টি যানবাহন। ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী মোটরসাইকেল চালকের সংখ্যা ১৮ লাখ ৫৩ হাজার। সংখ্যার হিসাবে প্রায় ১৫ লাখ মোটরসাইকেল চালকের লাইসেন্স নেই। ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকদের কারণে দুর্ঘটনাও তুলনামূলক বেশি মোটরসাইকেলে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, হঠাৎ করে সড়কে মাট গাড়ির তুলনায় ৫৫ শতাংশ মোটরসাইকেল সংযোজন হয়েছে।

বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবর সংকলন করে বুয়েটের এআরআই ও নিসচা।

নিসচার হিসাবে ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২৩২টি, যার ১ হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। ২০২১ সালে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২ হাজার ২১৪ জন, যা মোট নিহতের ৩৫ ভাগের বেশি।

এআরআইয়ের হিসাবে ২০১৬ সালে ২৮৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন মারা যান। ২০২০ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮টিতে, মারা যান ১ হাজার ৯৭ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০০৬ সালের এক গবেষণা বলছে, ভালো মানের একটি হেলমেট পরলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হওয়ার ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশ। আর মৃত্যুঝুঁকি কমে ৪০ শতাংশ।

বুয়েটের এআরআই ২০২০ সালে রাইড শেয়ারিংয়ের ৪৫০ মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীর ওপর একটি জরিপ করে। এতে দেখা যায়, ৫০ শতাংশ আরোহী চালকের চালানো নিয়ে অনিরাপত্তায় ভোগেন।

একই সংস্থার করা আরেক জরিপে এসেছে, চালকের ৩০ শতাংশ অতি নিম্নমানের হেলমেট পরেন। মাত্র ২ শতাংশ ক্ষেত্রে আরোহীদের ‘ফুলফেস’ হেলমেট দেওয়া হয়।

এআরআইয়ের পর্যবেক্ষণ বলছে, রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালকদের প্রতিযোগিতা ও ফাঁক গলে আগে যাওয়ার প্রবণতা দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ।

মন্তব্য

Beta version