সাধারণ মানুষের সেবা ও উন্নত বাংলাদেশ গঠনে জেলা প্রশসকদের প্রতি ২৪ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব ধরনের ভয়-ভীতি ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে নিজেকে জনগণের সেবায় নিয়োজিত করতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে তিনদিনের ডিসি সম্মেলন উদ্বোধন করে এসব নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে চলছে এই সম্মেলন। আজ বুধবার ও আগামীকাল বৃহষ্পতিবারও চলবে এই সম্মেলন। দুই বছর পর হওয়া এই সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী এবং প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েস সিদ্দিকী যুক্ত ছিলেন। করোনা আক্রান্ত হওয়ায় গতকাল প্রথমদিনে ৭ ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনার সম্মেলনে উপস্থিত হতে পারেননি।
গতকাল দিনের প্রথম অধিবেশনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থবিভাগ, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সংশিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরাও বক্তব্য দেন। কোভিড পরিস্থিতির কারণে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বৈঠকে অংশ নেন তারা।
করোনার কারণে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে উদ্বোধনী অধিবেশনও। এবার মাত্র ১৫টি মন্ত্রণালয়ের ১৫ জন মন্ত্রী ও সচিবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন শেষে প্রথম দিনের সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এরমধ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, বাস্তবায়ন পরীবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, অর্থ বিভাগ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, পরিকল্পনা বিভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে।
এবার সম্মেলনের তিন দিনে উদ্বোধনী অধিবেশনসহ মোট ২৫টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। এতে মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা মিলিয়ে মোট ৫৫ টি প্রতিষ্ঠানের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব, সচিব, উপদেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে আলোচনা করবেন। সম্মেলনে জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে ২৬৩টি এজেন্ডা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ১৮টি। এছাড়া, জনপ্রশাসন, শিক্ষা, স্থাানীয় সরকার বিভাগের প্রস্তাব সবচেয়ে বেশি।
উল্লেখ্য, জেলা প্রশাসক সম্মেলনে মন্ত্রী ও সচিবদের উপস্থিতিতে নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে নানা সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরেন জেলা প্রশাসকরা। এর বিপরীতে তাদের নানা দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়।
গতকাল সম্মেলন উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের উদ্দেশে বলেন, সেবার মনোভাব নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকলে আপনাদের পক্ষে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে। এতে সাধারণ মানুষ হবে উপকৃত। দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, সেবা নিতে এসে কোনো মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন। শুদ্ধাচার বাস্তবায়নের পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধে সোচ্চার হতে হবে।
জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, সরকারি সেবা নিতে এসে কোনো মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়। শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ যেন সরকারি সেবা পায় সে বিষয়ে আপনাদের আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
ডিসিদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ২৪ দফা নির্দেশনা: প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে, করোনা সংকট মোকাবিলায় সময়ে সময়ে সরকারের জারি করা নির্দেশনাগুলো মাঠপর্যায়ে প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে নেওয়া উন্নয়ন এবং সেবামূলক কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন ও এর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
সরকারি অফিসগুলোতে সাধারণ মানুষ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বিঘ্নে যথাযথ সেবা পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সেবাপ্রত্যাশীদের সন্তুষ্টি অর্জনই যেন হয় সরকারি কর্মচারীদের ব্রত।
এসডিজি স্থানীয়করণের আওতায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনে তৎপরতা জোরদার করতে হবে।
গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ, ভূমিহীনদের কৃষি জমি বন্দোবস্তসহ সব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যেন প্রকৃত অসহায়, দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। কোভিড পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যবস্থায় অনলাইন বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে পাঠদান কার্যক্রম যেন অব্যাহত থাকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলো যেন কার্যকর থাকে তা প্রতিনিয়ত তত্ত্বাবধান করা এবং নানা কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে।
শিশু-কিশোরদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে তাদের জন্য প্রত্যেক এলাকায় সৃজনশীলতার চর্চা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও ক্রীড়া সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
নাগরিকদের সুস্থ জীবনের জন্য জেলা-উপজেলায় পার্ক, খেলার মাঠ সংরক্ষণ এবং নতুন পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে উচ্চপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে। জনসাধারণের মাঝে তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে কাজ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ইত্যাদি রোধে নিতে হবে উদ্যোগ।
বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রতি ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রাখতে হবে। মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে হবে নিয়মিত।
এছাড়াও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাল্যবিয়ে, ইভটিজিং, খাদ্যে ভেজাল, নকল পণ্য তৈরি ইত্যাদি অপরাধ রোধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে।
বাজারে পণ্যের সরবরাহ মসৃণ, কৃত্রিম সংকট রোধ ও পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় প্রভৃতি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে; নিশ্চিত করতে হবে পরিকল্পিত নগরায়ন ও বনায়ন।
পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে নতুন নতুন পর্যটন স্পট।
জেলার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং জেলাভিত্তিক বিখ্যাত পণ্যগুলোর প্রচার ও বিপণনে উদ্যোগী হতে হবে।
জেলার সব সরকারি দপ্তরের কার্যক্রমগুলো যথাযথভাবে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে ব্রতী হতে হবে।
জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধি অর্থাৎ সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে। উন্নয়নের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা বা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি-না সেগুলো সমন্বয় করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প যত্রতত্র যেন না হয় সেদিকে দিতে হবে বিশেষ দৃষ্টি।
সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি- বেদে, জেলে, কৃষক, তৃতীয় লিঙ্গ (ট্রান্সজেন্ডার) ও হরিজন এবং পরিচ্ছন্নকর্মীসহ যারা একেবারে অনগ্রসর শ্রেণি তাদের সার্বিক উন্নয়ন, তাদের বাসস্থান এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার শিকার পরিবারদের বর্তমান অবস্থা জানা ও তাদের যথাযথ সম্মানজনক জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
সবশেষে গণকবর সংরক্ষণ ও যুদ্ধক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। ইতিহাস তুলে ধরতে হবে জনসমক্ষে।
মন্তব্য