-->
ডাম্পিং জোন

দেহ আছে প্রাণ নেই!

নিজস্ব প্রতিবেদক
দেহ আছে প্রাণ নেই!
রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও ট্রাফিক পুলিশের ডাম্পিং জোনে এভাবেই পড়ে আছে গাড়ি। ছবি : ভোরের আকাশ

আহ! কী একটা অবস্থা। দেহ আছে প্রাণ নেই। নিথর এ দেহ পড়ে আছে একাকী জঙ্গলে। আবার কারো বা শুধুই কঙ্কাল। কিডনি, কলিজা, এমনকি দেহের সব মাংস কুরে কুরে খেয়েছে ধুলো-বালি। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, অযত্ন-অবহেলায় দীর্ঘদিন মরিচা ধরে যেন কঙ্কাল হয়ে পড়ে আছে হাজারো যানবাহন। দেখে মনে হয়, এ যেন গাড়ির কবরস্থান। এসব গাড়ির নেই কোনো অভিভাবক। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, বৈধ কাগজপত্র না থাকা, ফিটনেস সনদ না থাকা, মামলার আলামতসহ বিভিন্ন কারণে যানবাহনগুলো জব্দ করে এসব ডাম্পিং স্থানে রাখে পুলিশ।

বলছি, রাজধানীর থানা ও ট্রাফিক পুলিশের ডাম্পিং জোনের কথা। শুনে হয়তো অবাক হচ্ছেন। কিন্তু রাজধানীর ডাম্পিং জোনগুলোতে গেলে মনে হয় যেন পরিত্যক্ত গাড়ির এক-একটি কবরস্থান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থানার একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ‘যেকোনো পুলিশের মোটরসাইকেলের জন্য পার্টস লাগলে সুবিধামতো ওইসব গাড়ি থেকে খুলে নেওয়া হয়। বেশির ভাগ গাড়িতে নেই পার্টস। আর বাকিগুলো ময়লা পড়ে জং ধরে নষ্ট হয়। যা ভাঙ্গারি হিসেবেও বিক্রি করা কষ্টকর। আইনে নেই, চাইলে বিক্রিও করা যাবে না।’

ডিএমপির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ‘এসব গাড়ি বছরের পর বছর পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যায় মামলা জোটে পড়ে। আবার কারো মোটরসাইকেলের কোনো যন্ত্রপাতির দরকার হলে এখান থেকে খুলে নিয়ে যায়।’

এদিকে বছরের পর বছর পড়ে থেকে ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে এসব গাড়ি। আবার চুরি হয়ে যাচ্ছে এসব গাড়ির অনেক যন্ত্রাংশ। অনেকটা দেহ আছে যেন প্রাণ নেই! এভাবেই থানা আর পুলিশের ডাম্পিং জোনে দীর্ঘদিন পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার যানবাহন।

পুলিশ বলছে, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় আটক বা জব্দ করা যানবাহন মালিকদের বুঝিয়ে দেওয়া যায় না। অনেক সময় মালিকদেরও আগ্রহ থাকে না। রাজধানীতে নানা কারণে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে প্রতিদিনই বেশ কিছু যানবাহন বাজেয়াপ্ত করা হয়। এরপর সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয় ডাম্পিং স্টেশনে।

ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় ট্রাফিক বিভাগের কোনো স্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন না থাকলেও বছরে গড়ে ১ থেকে ২ হাজারের মতো গাড়ি থাকে এসব ডাম্পিং স্টেশনে। যেখানে শুধু ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনেই নয়, বিভিন্ন মামলার আলামতের গাড়িও পড়ে থাকতে দেখা যায় বছরের পর বছর।

সরেজমিনে দেখা যায়, আগারগাঁওয়ের মূল ডাম্পিং স্টেশনটি একটি সরকারি জায়গার ওপরে। এখানকার কিছু গাড়ি ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের কারণে সাময়িক সময়ের জন্য রাখা হলেও অনেক গাড়ি পড়ে রয়েছে বছরের পর বছর। এসব পড়ে থাকা গাড়ির গা বেয়ে গজিয়েছে লতাপাতা। ঘন বন-জঙ্গলের কারণে কিছুটা গিয়ে আর যাওয়া সম্ভব হয় না। রিকশা থেকে শুরু করে বড় ট্রাক-বাস কী নেই এখানে। সব ধরনের যানবাহন রয়েছে ডাম্পিং স্টেশনে। ট্রাফিক আইনে আটক অধিকাংশ গাড়ির মালিক বা চালক এসে নিয়ে গেলেও থেকে যায় বিভিন্ন থানা থেকে আসা মামলার আলামতের জন্য রাখা গাড়িগুলো।

আগারগাঁওয়ের মূল ডাম্পিং জোনে দেখা যায় কোনো কোনো গাড়ি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পড়ে রয়েছে। ডাম্পিং স্টেশনে পড়ে থাকা গাড়ি দেখে মনে হয় যেন গাড়ি তো নয় এ যেন এক-একটি কঙ্কাল।

পুলিশ বলছে, দিনে গড়ে ২৫ থেকে ৩০টি গাড়ি আসে ডাম্পিং স্টেশনে। তাই নিজস্ব কোনো ডাম্পিং জোন না থাকায় বাধ্য হয়ে অনেক সময় থানার সামনে রাখা হয় মামলার আলামত হিসেবে।

পুলিশের একটি সূত্র বলছে, মামলার আলামতের পাশাপাশি বেওয়ারিশ গাড়িরও জায়গা হয় এখানে। দুর্ঘটনাকবলিত বিভিন্ন গাড়িও রয়েছে এসব স্টেশনে। দীর্ঘসময় পড়ে থাকায় একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে গাড়ি, অন্যদিকে রাস্তার ওপরে গাড়ি রাখায় ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, এভাবে গাড়িগুলো নষ্ট না করে যদি একটি অর্থদন্ড করা হতো তাহলে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেত গাড়ির মালিকরা, সরকারও পেত রাজস্ব। এতে যেমন ক্ষতি হচ্ছে দেশের, তেমনই ক্ষতি হচ্ছে মালিকদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) পদ মর্যাদার এক কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে জানান, ডাম্পিং জোনে দীর্ঘ দিন ধরে পড়ে থাকার কারণ হতে পারে দীর্ঘ মামলা জোট। চোরাই গাড়ি থাকে। বিভিন্ন অপরাধে ধরা পড়া গাড়িগুলো মালিক পক্ষ নিতে আসে না। গাড়িগুলো নিতে যেসব নিয়মনীতি অনুসারে কাগজপত্র থাকতে হয় সেগুলো না থাকার কারণে দীর্ঘ দিন পড়ে থাকার কারণে নষ্ট হচ্ছে।

সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম বলেন, বিভিন্ন মামলার জট থাকে সেগুলো আদালতের রায়ের ওপর নির্ভর করে। আদালত রায় না দেওয়া পর্যন্ত আটক গাড়ি ফেরত দেওয়ার সুযোগ নেই।

 

মন্তব্য

Beta version