-->
শিরোনাম
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে যে কারণে কমছে নারী শ্রমিক

নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে যে কারণে কমছে নারী শ্রমিক
তৈরি পোশাক শিল্পে ধীরে ধীরে কমছে নারী কর্মীর হার

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে এক সময় সিংহভাগ শ্রমিকই ছিল নারী। অথচ অব্যাহত হারে এই শিল্পে কমে যাচ্ছে নারী শ্রমিকদের হার। বর্তমানে এই শিল্পে কাজ করছেন মাত্র ৫৮ শতাংশ নারী শ্রমিক। তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর করা এক গবেষণায় এ চিত্র দেখা গেছে। এর কারণ অসুন্ধান করে দেখা গেছে কারখানাগুলোতে আধুনিক যন্ত্রাংশ স্থাপন করা হলেও সেভাবে বাড়ছে না নারী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ। মূলত দক্ষতার অভাব ও কারখানাগুলোতে নারী শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ না থাকায় নারীদের জায়গা ধীরে ধীরে দখল করছে পুরুষ শ্রমিকরা। এ গবেষণার তথ্যের ভিত্তিতে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বিবিসি বাংলায়। 

ব্র্যাক ইউনিভাসির্টির সেন্টার ফর অন্টারপ্রেনারশিপ ডেভলপমেন্ট বিভাগের আওতায় তৈরি পোশাক নিয়ে ম্যাপড ইন বাংলাদেশ নামে একটি প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে নারী এবং পুরুষ কর্মীদের অনুপাত শিরোনামে এই গবেষণাটি করা হয়েছে। গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ম্যাপড ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের লিড অপারেশন অফিসার আফসানা চৌধুরী।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, তৈরি পোশাক কারখানায় যারা কাজ করছেন বর্তমানে তাদের মাত্র ৫৮ শতাংশ নারী। ফলে এই খাতের ৮০ শতাংশ কর্মীই নারী বলে যে ধারণা প্রচলিত ছিল, সেটি ঠিক নয় বলে নতুন এই গবেষণা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

বিবিসি বাংলাকে আফসানা চৌধুরী বলেন, ২০১৭ সাল থেকে এই গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা শুরু হয়। মোট তিন হাজার ৫০০টি কারখানার তথ্য এতে সংগ্রহ করা হয়েছে যেগুলো রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করে থাকে।

তিনি বলেন, ‘এই ৩৫০০টি কারখানার তথ্যকে যদি বেইজ(ভিত্তি) হিসেবে ধরা হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, নারী শ্রমিকদের হার ৫৮ শতাংশ এবং পুরুষ শ্রমিকদের হার ৪২ শতাংশ।’

তৈরি পোশাক খাতে নারী-পুরুষ শ্রমিকের হার জানাটাই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল। আর তাই এই বিষয়টিতেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তথ্য বিশ্লেষণ করার সময় নারী শ্রমিকদের কমতি হারের বিষয়টি সামনে এসেছে বলেও জানানো হয়।

৮০ ভাগ নারী কর্মীর ধারণা যে কারণে

গবেষণায় বলা হয়েছে যে, তৈরি পোশাক শিল্পের ৮০ ভাগ কর্মীই নারী- দীর্ঘদিনের এই ধারণাটি এসেছে আসলে সিউয়িং বা সেলাইয়ে নারী শ্রমিক বেশি থাকার বিষয়টি থেকে।

বাস্তবে এই ধারণার পক্ষে তেমন কোন শক্ত প্রমাণ মেলেনি।

ম্যাপড ইন বাংলাদেশের যে গবেষণা সেখানে বলা হচ্ছে যে, সবচেয়ে বেশি নারী কাজ করেন উভেন এবং মিক্সড ফ্যাক্টরি বা যেখানে সব ধরনের পণ্য উৎপাদিত হয় এমন কারখানায়।

আর নিট এবং সোয়েটার কারখানায় পুরুষ কর্মীদের সংখ্যা বেশি।

তবে কারখানার অবস্থান, ধরন, আকার এবং উৎপাদন সেকশনের ওপর নির্ভর করে সেখানে নারী-পুরুষ শ্রমিকের হার কেমন হবে।

নারী শ্রমিক কমছে কেন?

তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, শ্রম ঘন খাত হওয়ার কারণে এবং নারী কর্মীদের শ্রম তুলনামূলক সস্তা হওয়ার কারণে এই খাতে নারী শ্রমিকদেরই আধিক্য ছিল।

শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা এবং গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলছেন, তৈরি পোশাক শিল্পে পুরুষের তুলনায় নারী কর্মীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হলেও এই চিত্রে পরিবর্তন আসছে। বাড়ছে পুরুষ কর্মীদের হার।

তার মতে, কারখানাগুলোতে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের সংযোজন এবং কর্মপরিবেশে গুনগত পরিবর্তন না আসা এর একটি বড় কারণ।

জলি তালুকদার বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এবং মালিকদের আচরণ এবং কারখানায় নারী বান্ধব পরিবেশ না থাকার কারণে নারীদের সংখ্যা কিছুটা কমেছে।

‘আবার কারখানাগুলোতে অটোমেশন আসার কারণে সেগুলো পরিচালনার সময় শিক্ষার বিষয়টি আসে আরকি। এসব কারণেও অনেক সময় কিছুটা কমেছে।’

তিনি বলেন, নারীদের মধ্যে শিক্ষিতের হার কম। ফলে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের অংশগ্রহণও কমছে।

পুরুষ শ্রমিক বাড়ার নেপথ্যে

তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে একাধিক গবেষণা পরিচালনা করেছেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি নারী শ্রমিকদের কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন।

তিনি বলেন, ‘নারীবান্ধব খাত বলে যে ধারণা ছিল সেটি থেকে সরে এসে সেখানে পুরুষদের সংযোজন বাড়ছে। কারণ অব্যাহতভাবে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, পণ্যের মান উন্নয়ন এবং পণ্যের বিশেষায়ণ হচ্ছে।’

তার মতে, প্রযুক্তির ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়াতে দক্ষ শ্রমিকের দরকার হয়। তবে দুর্ভাগ্যবশত নারী শ্রমিকরা দক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগটি পান না যেটা পুরুষরা পারেন।

তারা বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে কারখানাগুলোতে পুরুষদের সুযোগ বাড়ছে।

আরেকটি কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কারখানাগুলো ব্যয় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কম সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগের দিকে যাচ্ছে। ফলে লো এন্ডে যেখানে নারী শ্রমিকদের আধিক্য বেশি যেমন, হেলপার হিসেবে যারা কাজ করেন সেখানে শ্রমিকদের কাট-ছাঁট করা হচ্ছে।

এর বদলে উৎপাদন বাড়াতে মাল্টি টাস্কিং মেশিনারিজ ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে সেখানেও কাজের সুযোগ কমছে নারীদের।

আরেকটি প্রবণতা রয়েছে যে, যারা দক্ষ সেই সব শ্রমিকের সুযোগ বাড়ছে। ফলে এন্ট্রি লেভেলে শ্রমিকদের নিয়োগ কমছে।

সব কিছু মিলিয়েই নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ কম দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

'নিয়োগ দক্ষতার ভিত্তিতে'

বাংলাদেশের যেসব এলাকায় গার্মেন্টস রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রয়েছে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামে।

এসব জেলায় ৩২শর বেশি কারখানায় কর্মরত রয়েছেন ২৫ লাখের বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী রয়েছেন সাড়ে ১০ লাখ এবং নারী কর্মী রয়েছেন ১৫ লাখ।

বাংলাদেশে গার্মেন্টস কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ- এর ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলছেন, কর্মী নিয়োগের বিষয়ে নারী বা পুরুষের বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয় না। বরং দক্ষমতার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়।

তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে অনেক ওয়ার্কার দরকার। এখনো দুই তিন লাখ শ্রমিক আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু দক্ষ শ্রমিক পাচ্ছি না।’

মি. আজিম বলেন, করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে অনেকে গ্রামে চলে গেছে। সেখানে গিয়ে তারা নানা রকম ব্যবসা বা কর্মসংস্থানে জড়িয়েছেন। যার কারণে তাদের অনেকেই ফেরেননি।

তিনি বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি আমাদের শ্রমিক আসুক। নারী হোক-পুরুষ হোক, আমাদের শ্রমিকদের আসলেই অনেক অপ্রতুলতা আছে। আমরা চাই তারা আসুক। আমরা তাদের ওয়েলকাম করি।’

শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা মনে করছেন যে, গার্মেন্টস শিল্পে নারীদের যতি আবার বেশি মাত্রায় নিয়োগ করতে হয় তাহলে তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

আর এটি যত দ্রুত করা যাবে সেটি নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তত ইতিবাচক হবে।

মন্তব্য

Beta version