শিল্পমালিকদের অসহযোগিতা আর বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে করোনাকালীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বেকার শ্রমিকদের জন্য দেশি-বিদেশী অর্থায়নে সঞ্চিত তহবিলের টাকা শ্রমিকদের মাঝে বিতরণ করা সম্ভব হয়নি।
জানা যায়, করোনা মহামারিতে চাকরি হারানো বেকার শ্রমিকদের জন্য ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছিল। সেই তহবিলে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মান ফেডারেশন এবং ৩০০ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার।
২০২২ সালের জুনের মধ্যে বেকার হওয়া প্রায় ১২ লাখ শ্রমিকদের মাঝে এই টাকা বিতরণ করার কথা ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রপ্তানিমুখী উদ্যোক্তাদের অসহযোগিতার কারণে সেই টাকা বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় চাকরিচ্যুত ও বেকার শ্রমিকদের প্রতিজনকে মাসে ৩ হাজার টাকা করে তিন মাসের জন্য ৯ হাজার টাকা দেওয়ার কথা। এ টাকা বিতরণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের শ্রম অধিদপ্তর, শ্রমিক প্রতিনিধি ও রপ্তানিকারকদের সমন্বয়ে প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্ট কমিটি- পিআইসি গঠন করা হয়।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক বছরে মাত্র ৮ হাজার শ্রমিকের মাঝে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৪৯২ কোটি ৮০ লাখ টাকাই অবিতরণ রয়ে গেছে। শ্রমিক নেতারা বলছেন, বিতরণ ব্যবস্থাপনার ত্রুটি আর রপ্তানিকারকদের অসহযোগিতার কারণে ওই টাকা বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
শ্রম অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ২০২১ সালের শুরুতে তহবিল গঠন করার সময় শর্ত ঠিক হয়। শর্তানুযায়ী যে প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে ওই প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের তালিকা করে সংশ্লিষ্ট শিল্পের অ্যাসোসিয়েশন সত্যায়িত করার পর কমিটিতে পাঠাবে। কমিটি অনুমোদন করার পর সেই টাকা ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শ্রমিকের কাছে পাঠানো হবে।
টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে শ্রমিকের এনআইডি কার্ড সংযুক্তিকেই প্রধান শর্ত ধরা হয়। সেই তহবিল গঠনের পর গেল এক বছরে ৪০ হাজার শ্রমিক এই টাকা পেতে আবেদন করে।
পিআইসির সদস্য সচিব ও শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক আবু আশরিফ মাহমুদ ভোরের আকাশকে জানান, প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে যাচাই বাছাই করে ৮ হাজার শ্রমিককে টাকা দেওয়া হয়েছে। বাকি শ্রমিকদের এনআইডি না থাকার কারণে নিতে পারেননি।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তহবিলের টাকা শ্রমিকদের কাছে দিতে বার বার তাগাদা দেওয়া হয়। পিআইসি সূত্র এই প্রতিবেদককে জানায়, টাকা দেওয়ার জন্য আবেদন প্রক্রিয়ায় মালিক সমিতির সত্যায়ন ও এনআইডি থাকার শর্ত যুক্ত করার কারণে এগোতে পারছে না। শ্রমিকরা চাকরি হারালেও মালিকরা স্বীকার করতে চান না।
চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের শ্রমিকদের নাম দিলেও কমিটিতে থাকা অ্যাসোসিয়েশনের মালিকরা এ তালিকা তুলে নিয়ে গেছেন। রপ্তানিমুখী শিল্পের উদ্যোক্তারা শ্রমিক ছাঁটাইকে অস্বীকার করে অসহযোগিতা করছে।
দেশে তৈরি পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্প থেকে চাকরি হারানোর শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এসব শ্রমিককে স্বীকার করলে অবৈধ ছাঁটাইয়ের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
যে কারণে শিল্প মালিকরা ছাঁটাই করা শ্রমিকদের চাকরি হারানোর সুবিধা পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করছে না বলে মনে করছেন গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি আহসান হাবিব বুলবুল।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, যেহেতু শ্রমিকদের সঠিক কোনো ডাটাবেইজ নেই, মালিকরা অস্বীকার করছেন। তাই কমিটির শর্ত পরিবর্তন করে শ্রমিকদের পাওনা নিশ্চিত করতে হবে। টাকা কেন বিতরণ হচ্ছে না- তা স্পষ্ট করেছেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘তৈরি পোশাকশিল্পে কোনো শ্রমিক ছাঁটাই হয়নি। তৈরি পোশাক শিল্পে অনেক কাজ। আমরা এমনও বলেছি, কোনো শ্রমিক বেকার থাকলে তার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দেওয়া হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘করোনাকালীন এক মাস কারখানা বন্ধ ছিল। তারপর যখন কারখানা খোলা হয়েছে সবাই চাকরি ফিরে পেয়েছেন।
এ সময় কোনো শ্রমিক যদি বেকার থেকে থাকেন তাহলে তা হয়েছে তাদের চাকরি করার অনিচ্ছার কারণে। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়নি।’ ৪০ হাজার বেকার শ্রমিক আবেদন করেছেন এবং এরমধ্যে ৮ হাজার শ্রমিক সহায়তা পেয়েছেন, এমন তথ্যে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘যারা সহায়তা নিয়েছেন এরা কারা?
এমন হতে পারে রানা প্লাজা বা অন্য কারণে যেসব শ্রমিক বেকার ছিলেন বা পঙ্গু জীবনযাপন করছেন তারা এই সহায়তা নিয়েছেন। করোনার কারণে কোনো শ্রমিক বেকার হননি, সহায়তা নেওয়ারও প্রয়োজন নেই।
যে তহবিল আছে সে টাকা দিয়ে প্রয়োজনে শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের জন্য পাঁচটি হাসপাতাল তৈরি করা হোক।’ শ্রমিকরা যাতে চাকরিচ্যুত না হন এজন্য সরকার ২ শতাংশ সুদ হারে প্রণোদনা দিয়েছে।
তিন দফায় প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার এ প্রণোদনা নেন রপ্তানিমুখী শিল্পের মালিকরা। অথচ করোনাকালীন এক বছরের নিচে চাকরির বয়স, এমন অস্থায়ী শ্রমিকদের ছাঁটাইয়ের আইনি সহায়তা পেয়ে বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে ছাঁটাই করে শিল্প মালিকরা।
শ্রমিক সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী তৈরি পোশাক, বস্ত্র, ফরোয়ার্ডিং ও ব্যাকলিংকেজ শিল্পেই এ ধরনের শ্রমিকের সংখ্যা ১০ লাখ। রপ্তানিমুখী অন্য শিল্পকারখানা মিলে করোনাকালে চাকরি হারানো মোট শ্রমিকের সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এসব শ্রমিকদের অনেকে এখনো বেকার আছেন।
তৈরি পোশাকশিল্প খাতের আরেক নেতা, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার ভোরের আকাশকে বলেন, ‘এ টাকা দ্রুততম সময়ের মধ্যে চাকরি হারানো বেকার শ্রমিককে দেওয়ার জন্য।
প্রয়োজনে ব্যবস্থাপনাগত যেসব ত্রুটি আছে সেগুলো দূর করে টাকা শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমরা করোনার শুরু থেকে বলেছি, শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না।
চাকরির বয়স এক বছরের কম, এমন শ্রমিককে অস্বীকার করার মানসিকতা থেকে অনেক মালিক সরকারের দেওয়া ২ শতাংশ সুদ হারের প্রণোদনাও নেননি। একই কারণে তারা এ টাকা শ্রমিকদের পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে না।’
তবে গত মাস দুয়েক ধরে রপ্তানি খাতের শ্রমিক নেতাদের কমিটিতে যুক্ত করার পর বিতরণের প্রতিবন্ধকতা কিছুটা দূর হয়েছে বলে মনে করেন পিআইসির অন্যতম সদস্য, চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের শ্রমিক নেতা ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম।
তিনি বলেন, ‘টাকা বিতরণে গঠিত কমিটি শুরুতেই ভুল ছিল। তা হলো মালিকরা শ্রমিকদের ছাঁটাই করেন কিন্তু স্বীকার করেন না। অথচ সেই কমিটিতে রাখা হয়নি শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী ট্রেড ইউনিয়নকে।
এ কারণে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করলেও তাদের ক্ষতিপূরণে গঠিত হওয়া তহবিলের বিপুল পরিমাণ অর্থ অব্যবহৃতই রয়ে গেছে।’
মন্তব্য