-->

ভাষার ব্যবহার নিয়ে প্রথম প্রতিক্রিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক
ভাষার ব্যবহার নিয়ে প্রথম প্রতিক্রিয়া
প্রতীকী ছবি

ভাষা-বিতর্কের উল্লিখিত টানাপোড়েনের মধ্যে হঠাৎ করেই একটি বিস্ফোরক ঘটনা পাকিস্তান অর্জনের প্রবল আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে আঘাতের প্রতিক্রিয়া করে। শিক্ষিত বাঙালির একটি অংশ (বিশেষ করে ঢাকার সরকারি কর্মচারীদের একটি অংশই এদিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন) বিস্ময়, বেদনা ও অপমানবোধ নিয়ে লক্ষ করেন যে, পাকিস্তানে প্রথম প্রকাশিত এনভেলাপ, পোস্টকার্ড, ডাকটিকিট, মনিঅর্ডার ফরম, রেলটিকিট ইত্যাদিতে এবং সদ্য ছাপানো টাকায় বাংলার বদলে শুধু ইংরেজি ও উর্দু ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে।

ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিকের লেখা ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য গ্রন্থে আরো লিখেছেন, ‘এ দেশের শিক্ষিত জনগণ, বিশেষ করে ছাত্র-শিক্ষক সরকারি কর্মচারী ও অন্যান্য চাকরিজীবী সবাই তাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসে চিরচেনা মাতৃভাষার উপস্থিতি আশা করেছিলেন। এবং পাকিস্তান তথা স্বাধীনতা লাভের ফলাফল হিসেবেই আশা করেছিলেন। পরিবর্তে স্বপ্নভঙ্গের প্রথম প্রতিক্রিয়ায় দেখা দেয় অসন্তোষ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস আগে কিছুসংখ্যক লেখক-সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীর রচনা ও বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভাষাসংক্রান্ত যেসব দাবির তত্ত¡গত প্রকাশ ঘটেছিল, পাকিস্তানি শাসকদের এই অর্বাচীন পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় সেই তত্ত¡গত দাবির বাস্তব রূপ দেখা দিল অসন্তুষ্টির বিক্ষুব্ধ প্রকাশে।’

বইতে আরো লেখা রয়েছে, ‘শুধু ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষকগণই নন, পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকে বসবাসরত সরকারি কর্মচারীদের একটি বিশাল অংশ নিজ নিজ প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে উল্লিখিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এতটুকু দেরি করেননি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত এইসব জমায়েত ও খÐ মিছিলের প্রতিবাদ দেখা দিয়েছিল সাতচল্লিশ সালের নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে।

‘বাংলাকে সবকিছুতেই স্থান দিতে হবে’, ‘বাংলা ভাষা ও বাঙালির সাথে বেইমানি চলবে না’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘উর্দুর সাথে বিরোধ নাই’, ‘উর্দু-বাংলা ভাই ভাই’ ইত্যাদি ধ্বনির মাধ্যমে এদের ক্ষুব্ধ বেদনা ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটেছিল’ এসব বিষয় তুলে ধরে বইতে আরো লেখা হয়েছে, অবশ্য তাদের প্রধান দাবি ছিল উল্লিখিত ডাকটিকিট ফরম ইত্যাদিতে বাংলার উপস্থিতি’।

আরো বলা হয়, ‘বাংলা ভাষার বাস্তব প্রয়োগের বিষয় নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আড়াই মাসের মধ্যেই সরকারি কর্মচারীদের এই স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের বিবরণ ইতঃপূর্বে প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, স্মৃতিচারণ ও সংশ্লিষ্ট নিবন্ধাদিতে স্থান পায়নি। একমাত্র বশীর আল হেলালের বইটিতে এইসব টিকিট ফরম ছাপা সম্পর্কে পূর্ববঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের একটি প্রাসঙ্গিক উক্তির উল্লেখ রয়েছে মাত্র, অন্যত্র তাও নেই’।

মুখ্যমন্ত্রী পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের অধিবেশনে (৯ এপ্রিল, ১৯৪৮) উত্থাপিত এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে, ‘ভাষা সম্পর্কিত বিতর্ক আরম্ভ হওয়ার আগেই এইসব ফরম ও মুদ্রা ছাপা হয়। প্রকৃতপক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর এই যুক্তি মোটেই ধোপে টেকে না এই জন্য যে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক বিতর্ক সাতচল্লিশের জুন মাস থেকেই অব্যাহত ধারায় চলেছিল। আসলে বাঙালি-অবাঙালি লীগ শাসকগণ গোড়াতেই ধরে নিয়েছিলেন যে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং সব রাষ্ট্রীয় কাজে ইংরেজির স্থান উর্দুই দখল করবে...’।

মন্তব্য

Beta version