-->

ধরন পাল্টাচ্ছে শীতকাল

শাহীন রহমান
ধরন পাল্টাচ্ছে শীতকাল

ধরন বদলে যাচ্ছে শীত ঋতুর। আগের মতো ঘড়ির কাটা ধরে প্রকৃতিতে শীত নামছে না। সেই সঙ্গে শীতকালের পরিধিও কমে আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্বে উষ্ণায়নের কারণে বিশ্বে যে কয়টি দেশের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই পরিবর্তনের প্রভাব শীত ঋতুতেও স্পষ্ট হচ্ছে। ফলে একেক বছর শীত একেক রকম আচরণ করছে।

এবারের শীত ঋতু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মাঘের বিদায় বেলায় সারা দেশ এখন শীতে কাহিল। প্রতিদিনই কমছে তাপমাত্রা। উত্তরের জনজীবনের শীতে প্রভাব বেশি মাত্রায় অনুভ‚ত হচ্ছে। দিনের বেশিরভাগ সময় কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে। অথচ ফাল্গুনী হাওয়াও দ্বারপ্রান্তে। ঋতুর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রকৃতি থেকে আস্তে আস্তে শীত বিদায় নেওয়া কথা। ঘটছে তার উল্টো। এবারের ঘড়ির কাটা ধরে প্রকৃতিতে শীত নামেনি। ঋতুবৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী পৌষ মাসকে ভরা শীত হিসেবে ধরা হয়। এবার সেই পৌষেও শীতের দেখা মেলেনি। প্রথম মাসে শীতের দেখা মেলেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছে বিশ্বে উষ্ণায়নের কারণে শীতের ধরন বদলাতে শুরু করেছে।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন শীতের তিনটি প্যারামিটার রয়েছে। প্রথম প্যারামিটার হলো ঋতু শুরু হওয়ার আগেই উত্তরের হিমেল হাওয়া প্রকৃতিকে প্রবেশ করে। ফলে বাংলাদেশে অক্টোবরে শেষ থেকেই শীত অনুভ‚ত হতে থাকে। ডিসেম্বরের এসে তা জাকিয়ে নামে। এর বাইরেও শীতকালে বৃষ্টিপাত এবং শৈত্যপ্রবাহের কারণে অনুভ‚তি বাড়ে। এছাড়া কুয়াশাও শীতনামার ক্ষেত্রে বড় ভ‚মিকা পালন করে। সম্প্রতি বছরগুলোতে শীতের এসব প্যারামিটার কাজেই আসছে না। এবার শীত ঋতুতে বড় ধরনের শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়নি। মাঝে কয়েকদিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত হলেও তা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। প্রকৃতি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় শীত নামছে জাঁকিয়ে। আবহওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীতের এই বিরূপ আচরণ। বিশ্বে উষ্ণায়নের প্রভাব পড়ায় শীতকাল তার বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারছে না।

এবারে পৌষের তাপমাত্রায় বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। আবহাওয়া অফিসের রেকর্ডে দেখা গেছে, গত ৯ জানুয়ারি গত ৪৩ বছরের মধ্যে অন্যান্য বছরের একই দিনের তুলনায় উষ্ণতম ছিল। এ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। পরের দিন ১০ জানুয়ারির তাপমাত্রা বছরের একই সময়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রার তুলনায় ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি রেকর্ড হয়েছে। ওই দিনের বেলা কক্সবাজারে সর্বোচ্চ ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ রকম তাপমাত্রা সাধারণত গ্রীষ্ম মৌসুমে দেখা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বে উষ্ণায়ন যে বাড়ছে তা আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। ইউরোপীয় কমিশনের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংস্থা দ্য কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস রিপোর্টে বলা হয়েছে গত সাত বছর ছিল উষ্ণতম বছর। আর এই তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে ছিল ২০২১ সাল। বছরটিতে বেশ কিছু এলাকায় রেকর্ড পরিমাণ গরম পড়েছিল।

ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ আইপিসিসি বা জলবায়ুুবিষয়ক আন্তরাষ্ট্রীয় প্যানেলের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের এই বিজ্ঞানী প্যানেল হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন দ্রুতহারে সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং বরফ গলছে। বরফ গলা পানি গিয়ে পড়ছে সাগরে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাগরে তাপ বাড়ার ফলে আবহাওয়া দিনকে দিন বিপজ্জনক আচরণ করবে। সামুদ্রিক ঝড় বেশি হবে, জলোচ্ছাস বাড়বে।

সমীক্ষায়ও দেখা গেছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীতকালেও স্বাভাবিক তাপমাত্রা বাড়ছে। শীতকালে (ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে) যেখানে স্বাভাবিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫ দশমিক ৪ ও ২৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪ দশমিক ২ ও ১২ দশমিক ৪ ডিগ্রি। বর্তমানে শীতের এই গড় তাপমাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজ পরিচালিত এক সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের হার মাঝামাঝি হলেও ২০৭৫ সালে হার দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাপমাত্রা পরিবর্তনের হার অনেক বেড়ে যাবে। ২০৩০ সালে তাপমাত্রা বাড়ার হার প্রধানত দেখা দেবে শীতের মাসগুলোতে। যদিও শীত পরবর্তী মাসগুলোতে (এপ্রিল, মে ও জুনে) বেশিরভাগ পরিবর্তন দেখা দেবে। ২০৭৫ সালের এপ্রিল থেকে মে মাসের তাপমাত্রা বাড়ার হার বেশি হবে।

মন্তব্য

Beta version