-->
বরকত স্মৃতি জাদুঘর

ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিজাগানিয়া

যোবায়ের আহমদ
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিজাগানিয়া
ঢাবিতে ভাষাশহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। ছবি ভোরের আকাশ

চারদিকে মিছিল আর স্লোগান ভেসে আসছে' ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। হঠাৎ পুলিশের গুলি, ঢলে পড়লেন ‘সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক’। তাজা গরম রক্তে পিচঢালা রাস্তা যেন কৃষ্ণচ‚ড়ার প্রতীক হয়ে উঠল। পরদিন ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় ফলাও শিরোনাম হয় ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে ছাত্র সমাবেশের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন ছাত্রসহ চার ব্যক্তি নিহত’ একটি আন্দোলন, একটি ভাষা, একটি দেশের স্বাধীনতার সূচনা। এসব মুহূর্ত যেন জীবন্ত হয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত ‘ভাষাশহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা’য়।

ভাষা, ভাষা আন্দোলন এবং ভাষাশহীদ আবুল বরকতকে ধারণ করে জাদুঘরটি দাঁড়িয়ে আছে পলাশীসংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ভিতরে। দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল ভবনটিতে প্রবেশ করলেই বামপাশে পরিচালক এবং অফিস সহকারীর রুম এবং ডানপাশে মার্বেল পাথরে আঁকা ভাষাশহীদ আবুল বরকতের ম্যুরাল এবং পাশে সাদা স্লেটে কালো অক্ষরে সাঁটা রয়েছে তার সংক্ষিপ্ত জীবনী। আবুল বরকত ১৯২৭ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম আবাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নকালে মহান ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন তিনি। ওই বছরের ২১ ফেব্রæয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুবরণ করেন।

আরেকটু এগিয়ে এন্ট্রি বইয়ে নাম ঠুকে ভিতরে প্রবেশ করতেই নজর কেড়ে নেবে দেয়ালে বিশাল ক্যানভাসে আঁকা ভাষা আন্দোলনের চিত্রকর্ম' ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে ছাত্রদের মিছিল। মিছিলে সরকারি বাহিনীর গুলিবর্ষণ। গুলিতে শহীদ ও তাদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনার এবং তারপর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, শ্রদ্ধাঞ্জলি ও প্রভাতফেরির দৃশ্য রয়েছে।

নিচে বামপাশের শুরুতেই রয়েছে দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে বিভক্ত ভারতবর্ষের একটি মানচিত্র, তমুদ্দিন মসলিসের একখানা পুস্তিকা। রয়েছে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন মুহূর্তকে ক্যামেরায় বন্দি করা স্থিরচিত্র এবং তৎকালীন পত্রিকায় প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের প্রতিবেদন, প্রামাণ্য চিত্র, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগার থেকে মুক্তির ছবি, ‘ধাবাই’-এর শৈশবকালের ছবি।

সামনে একটি বোর্ডে টাঙানো রয়েছে কানাডায় অবস্থিত বহুভাষিক ও বহুজাতিক ভাষাপ্রেমিক গোষ্ঠীর একটি চিঠি। এই চিঠিতেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব করা হয়। ডান পাশে আছে নিদর্শন ও আলোকচিত্র। কাচের শোকেসে রাখা ভাষাশহীদ আবুল বরকতের ব্যবহৃত একটি খেলনা, তিনটি কাপ-পিরিচ, মরণোত্তর একুশে পদক, বাবাকে লেখা বরকতের তিনটি চিঠি, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের ডিগ্রির সনদ, পরিবারের পরিচিতি, একুশের গান শিহরণ জাগাবে যে কারো মনে।

বাবাকে লেখা একটি চিঠিতে বরকত লিখেছেন, ‘পাক জনাবেষু বাবাজান, আমার সালাম গ্রহণ করিবেন। আশা করি খোদার ফজলে ভালো আছেন। অনেক দিন হইতে আপনাদের কোনো সংবাদ না পাইয়া বড় চিন্তিত আছি। আমি আপনাকে একখানা চিঠি দিয়েছি, বোধ হয় পেয়েছেন। ইউনিভার্সিটিতে এখনো ভর্তি হওয়া হয় নাই, তবে ২/৪ দিনের মধ্যে ভর্তি হব। ’

জাদুঘরের ওপরতলায় একটি পাঠাগার রয়েছে। পাঠাগারে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর পাঁচ শতাধিক বই রাখা হয়েছে। আরো বই সংগ্রহের কাজ চলছে। সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত দর্শনার্থীদের জন্য রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই জাদুঘর। তবে করোনাকালে বিকাল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবিদ রাসেল বলেন, ‘জাদুঘর ঘুরে দেখে মনে হলো যেন ১৯৫২ সাল দেখছি। দুঃখ-গৌরবের মিশ্র অনুভূতি। প্রতিটা মুহূর্ত এখানে জীবন্ত। এই ঘর ঘুরলে যে কারো মধ্যেই দেশপ্রেম জেগে উঠবে।’ আক্ষেপ করে এই শিক্ষার্থী আরো বলেন, ‘জাদুঘরটি অখ্যাত রয়ে গেছে। কেউ এটির ব্যাপারে তেমন জানে না। প্রত্যেকের এই জাদুঘরটি ঘোরা উচিত।’

ভাষাশহীদ আবুল বরকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তারই নামে ২০১২ সালের ২৫ মার্চ এই স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন ভাষাসৈনিক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান।

মন্তব্য

Beta version