রাজধানী ঘিরে গড়ে উঠেছে ভেজাল ও নকল মাদক তৈরির কারখানা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একের পর এক অভিযান চালালেও এসব কারখানা বন্ধ করা যাচ্ছে না। মাদক কারবারিরা নিত্যনতুন কৌশল
অবলম্বন করে চালাচ্ছে মাদক ব্যবসা। দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে মাদক এনে রাজধানীতেই গড়ে তোলা হচ্ছে মাদক কারখানা।
এসব কারখানায় প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে আইস, মদ, ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক। তবে এ কারখানাগুলোয় তৈরি মাদক খুবই নিম্নমানের। বিভিন্ন সময় এসব কারখানায় অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা মাদকে
মিলেছে রাসায়নিক উপাদান। ফলে এসব মাদকসেবন করে অনেকেই রয়েছে মৃত্যুঝুঁকিতে। গত কয়েক মাসে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকা থেকে বেশ কয়েকটি মাদক কারখানার সন্ধান পায়
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর রামপুরার রিয়াজবাগ এলাকায় একটি ভেজাল মদের কারখানায় অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ঢাকা মেট্রো
কার্যালয় (উত্তর)। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় তিন মাদক কারবারিকে।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো (উত্তর) কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির উপপরিচালক মো. রাশেদুজ্জামান জানান,
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রামপুরা এলাকায় ভেজাল মদ তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে ওই কারখানায় অভিযান চালিয়ে স্পিরিট, ভেজাল মদ তৈরির রং, ফানেল, বিভিন্ন
ব্র্যান্ডের ভুয়া লেবেলসহ বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন উপকরণ জব্দ করা হয়। এ সময় কারখানাটির মালিক আশরাফুজ্জামান ওরফে মোশারফসহ (৩৫) তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার বাকি দুজন হলেন
মো. আবুল খায়ের চৌধুরী (৬৯) ও মো. হায়দার ভূঁইয়া (৩৬)। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ১০ বোতল বিদেশি ব্লাক লেবেল, ৫ বোতল নেমিরফ, ৮ বোতল কেরুস ফাইন ব্রান্ডি, মদ তৈরির উপকরণ
ইথানল ২০ লিটার, এসেন্স ৪০০ গ্রাম, চারকল পাউডার ৪৫০ গ্রাম, বোতলজাত করার পাইপ একটি, বিদেশি মদের লেবেল ৮০টি, মদের কর্ক ৮০টি, খালি বোতল ৩০টি ও একটি স্টিলের চোঙ্গা জব্দ করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, ইতোপূর্বে ভেজাল মদ পান করে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। ফলে ডিএনসি ডিজি ভেজাল মদ প্রতিরোধের নির্দেশনা দেন। এরই
ধারাবাহিকতায় অভিযানটি পরিচালনা করা হয়।
ভেজাল মদ তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে ডিএনসির ঢাকা মেট্রো উত্তরের সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান বলেন, বিভিন্ন ভাঙারির দোকান থেকে চক্রটি প্রথমে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদের খালি বোতল সংগ্রহ
করত। পরে তারা অবৈধভাবে মদ তৈরি করার স্পিরিট তৈরি করে। এছাড়া মদ তৈরি করার আরো রাসায়নিক উপকরণ সংগ্রহ করে চক্রটি। পরে এমনভাবে তারা ভেজাল মদ তৈরি করে বোতলজাত করত
যা দেখলে কোনোভাবেই মনে হবে না নকল। পরে তারা বাজারে আসল মদ বলে এই ভেজাল মদ বিক্রি করত। গ্রেপ্তাররা জানায়, গত ছয় মাস ধরে তারা এই ভেজাল মদ তৈরি করে বিক্রি করে আসছিল।
কোনো ওয়ার হাউসগুলো তাদের কাছ থেকে মদ কিনত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএনসি কর্মকর্তা মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, এরা কোনো ওয়ার হাউসের কাছে মদ বিক্রি করত না। তারা খুচরাভাবে
সরাসরি ক্রেতাদের কাছে মদ বিক্রি করত। এছাড়া নতুন বিধিমালা অনুযায়ী বারগুলো বিদেশি মদ আমদানি করতে পারবে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ দেশি ও ৪০ শতাংশ বিদেশি মদ রাখতে পারবে বারগুলো।
ভেজাল মদ মানুষজন কেন কিনছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মদের দাম একেক সময় একেক রকম। ভেজাল মদের তো দামের কোনো সীমা নেই। ভেজাল মদের তৈরি খরচই তো অনেক কম।
এছাড়া তারা ভেজাল মদের এমনভাবে বোতলজাত করে যে, মানুষ এটা বুঝতে পারে না আসল নাকি নকল। যারা তাদের কাছ থেকে কিনেছে তারা আসল মদ মনে করেই নিয়ে গেছে।
চক্রটি ভেজাল মদ তৈরি করার উপকরণগুলো কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে এবং এ ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা গ্রেপ্তারদের রিমান্ডে নেব। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের
কাছ থেকে জানার চেষ্টা করব এই উপকরণগুলো তারা কীভাবে সংগ্রহ করেছে। তথ্য পাওয়ার পর এ বিষয়ে আমরা পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেব।
এর আগে রাজধানীর জিগাতলার একটি বাসায় ‘আইস’ নামক একটি মাদক তৈরির কারখানার সন্ধান পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। পরে অভিযান চালিয়ে জিগাতলার ৬২ নম্বর বাড়িটির আন্ডারগ্রাউন্ড
থেকে আইস ও ক্রিস্টাল ম্যাথ তৈরিতে ব্যবহৃত নানা উপকরণ পাওয়া যায়। পাশাপাশি এসব উপাদান প্রক্রিয়াজাত করার কাজে ব্যবহৃত বেশ কিছু অত্যাধুনিক মেশিন উদ্ধার করা হয়। ২৯ গ্রাম মাদকসহ
বিপুল পরিমাণ মাদক তৈরির কাঁচামাল জব্দ করে কারখানাটি সিলগালা করে দেওয়া হয়।
মাদক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মরণনেশা ইয়াবার চাহিদা থাকায় এক শ্রেণির প্রতারক দেশেই কারখানা খুলে তা তৈরি করছে। অবৈধ পণ্য হওয়ায় তা যাচাইয়ের সুযোগ না থাকায় ইয়াবা হিসেবে তা গ্রহণ করছে মাদকসেবীরা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান মিথাইল অ্যামফিটামিন এবং ক্যাফেইন। একটি ট্যাবলেটে ৩০ থেকে ৩৫ মাত্রার মিথাইল
অ্যামফিটামিন এবং বাকিটা ক্যাফেইন। তবে দেশে আটক বেশিরভাগ ইয়াবার ক্ষেত্রে সে পরিমাণ উপাদানের উপস্থিতি নেই। তা ছাড়া স্থানীয়ভাবেও এসব উপাদান দিয়ে ছোটখাটো কিছু ওষুধ প্রস্তুতকারী
প্রতিষ্ঠান ইয়াবা ট্যাবলেট বানানোর চেষ্টা করছে। সে ক্ষেত্রে ইয়াবার মতো ভয়ংকর মাদক তৈরির উপাদান আমদানির ওপর কড়া নজরদারি করা উচিত বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে।
পুলিশের মাদকদ্রব্য উদ্ধার টিমের এক কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে জানান, এখন পর্যন্ত ঢাকাতেই অন্তত ইয়াবার ৫টি নকল কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এসব কারখানার মধ্যে ‘জুবায়েরের ইয়াবা
কারখানা’ ছিল সবচেয়ে বড়। রাজধানীর নিকেতনের একটি ফ্ল্যাটে আবদুল্লাহ জুবায়ের নামে মিয়ানমারের ওই নাগরিক ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। তবে উৎপাদনের আগেই জুবায়ের গত বছর
ডিবি পুলিশের হাতে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা, পাজেরো গাড়ি, ইয়াবা তৈরির মেশিনসহ গ্রেপ্তার হন। ওই সময় জুবায়ের জানিয়েছিলেন, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার করতে অনেক টাকা খরচ হয়। তাই
তিনি মেশিন বসিয়ে ঢাকাতেই নকল ইয়াবা তৈরি করে তা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।
গত বছর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ইয়াবা তৈরির নকল কারখানার সন্ধান পায় ডিবি পুলিশ। ওই কারখানা থেকে সহস্রাধিক ইয়াবা, কাঁচামাল, সরঞ্জামসহ চারজনকে আটক করা হয়। ওই কারখানার
মালিক ছিলেন আলী আকবর। আটকের পর আলী আকবর জানিয়েছিলেন, তিনি শুরুতে ওষুধের নকল কারখানা স্থাপন করলেও চাহিদা থাকায় এবং লাভ বেশি হওয়ায় ইয়াবা উৎপাদন করে রাজধানীর
বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করে আসছিলেন। এর আগে ২০১২ সালে রাজধানীর মধ্য বাসাবো এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইয়াবা তৈরির নকল কারখানা আবিষ্কার করে পুলিশ।
বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া নকল ইয়াবা কারখানার মালিকরা জানান, সোডিয়াম বেনজোয়েট, ক্যাফেইন ও ভেনিলার পাউডার মিশিয়ে তারা নকল ইয়াবা তৈরি করেন। অনেক সময় ছোট আকারের ওষুধ
কোম্পানি থেকে ইয়াবা সাইজের ট্যাবলেট তৈরি করিয়ে সে সব ট্যাবলেটে শুধু ইয়াবার ফ্লেভার (গন্ধ) মিশিয়ে তা ইয়াবা আকারে বিক্রি করা হয়। এসব নকল ইয়াবা পরিচিত ডিলারদের কাছে প্রতি পিস ৩০
টাকা এবং অপরিচিত ডিলারদের কাছে বিক্রি করা হয় তা ৮০ থেকে ৯০ টাকায় ।
মন্তব্য