-->
শিরোনাম

বিনা পয়সায় একবেলা খাবার

প্রণব কর্মকার
বিনা পয়সায় একবেলা খাবার
ভালো কাজের হোটেলে ক্ষুদার্ত মানুষের খাবারের অপেক্ষা

‘এই শহর, জাদুর শহর, প্রাণের শহর ঢাকারে; এই শহর, জাদুর শহর, প্রাণের শহর আহারে’Ñ জনপ্রিয় এ গানটি রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে লেখা। একটু ভালোভাবে, স্বাচ্ছ্যন্দে জীবন কাটানোর জন্য,

ভালো আয়ের জন্য, একটা ভালো চাকরির আসায় মানুষ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রতিনিয়ত ছুটে আসছেন এ রাজধানীতে। দেশের সিংহভাগ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও এ রাজধানীকে ঘিরেই। কিন্তু এ

রাজধানীতে একমুঠো ভাতের জন্য ময়লার ভাগাড়েও পাওয়া যায় অসংখ্য মানুষ।

অনেক কথা, অনেক গান আছে রাজধানীকে ঘিরে। এই শহরে নাকি স্বার্থ ছাড়া মানুষ কোনো কাজ করে না। এত কথা যে শহরকে নিয়ে, যেখানে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চলে টাকার নেশায়, সেই শহরে বিনা

পয়সায় খাবার পাওয়া যাওয়ার কথা তো ভাবাই যায় না। কিন্তু না, সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছেন একদল তরুণ। রাজধানীর বুকে গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমী এক খাবারের হোটেল ‘ভালো কাজের

হোটেল’। যেখানে খেতে লাগে না কোনো টাকা, সারা দিনে শুধু একটি ভালো কাজ করলেই মিলে খাবার। এই একদল তরুণের উদ্যোগে আবারো মনে পড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সবুজের অভিযান’

কবিতার কথা- ‘চিরযুবা তুই যে চিরজীবী/জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে/প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।’ রাজধানীর কমলাপুরে আইসিডি কাস্টমস হাউসের পাশে গেলেই চোখে পড়বে দেয়ালে বড় অক্ষরে লেখা

রয়েছে, ‘ভালো কাজের হোটেল।’ ‘এখানে খেতে টাকা লাগবে না, যেকোনো একটি ভালো কাজ করলেই হবে’।

সময় তখন সন্ধ্যা ৭টা, বুধবার। কমলাপুর আইসিডি কাস্টমস হাউসের পাশে পুরোনো বাজার জামে মসজিদের সামনের ফুটপাতে সারি দিয়ে বসে আছেন ছোট-বড় নানা বয়সের মানুষ। তরুণ বয়সি

একজন প্রত্যেকের পাশে গিয়ে কি যেন বলছেন, আর খাতায় লিখছেন। কাছে যেতেই দেখা গেল, সবাইকে দুটি প্রশ্ন করছেন তিনি। ‘আপনার নাম?’, ‘আজ আপনি কী ভালো কাজ করেছেন?’ উত্তর জেনে

টুকে রাখছেন হাতে থাকা খাতায়। এভাবে একবারে ৪০ জনের তথ্য নেওয়া হচ্ছে। এরপর প্লেট ভর্তি খাবার ধরিয়ে দিচ্ছেন হাতে হাতে। মাত্র এই ৪০ জনকে নয়, এ কমলাপুরেই প্রতিদিন রাতে একবেলা ফ্রি

খাবার দেওয়া হয় প্রায় ৩০০ ব্যক্তিকে। শুধুই কমলাপুরে নয়, রাজধানীর বনানী ও হাতিরঝিলেও এভাবে ফ্রি খাবার দেয় সংগঠনটি। বনানী ও হাতিরঝিলে খাবার দেওয়া হয় প্রতিদিন দুপুর বেলা। সব মিলিয়ে

তিনটি স্থানে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ লোককে তারা খাবার দিয়ে থাকে।

উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে কয়েকজন তরুণ ‘ইয়থ ফর বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে শুরু করেন ছিন্নমূল মানুষকে সপ্তাহে প্রতিদিন একবেলা

খাওয়ানো। বর্তমানে রাজধানীর কমলাপুরের আইসিডি কাস্টম হাউসের কাছের ফুটপাতে ‘ভালো কাজের হোটেল’ নামে হতদরিদ্র এবং ছিন্নমূল মানুষকে প্রতিদিন একবেলা খাবার খাওয়ান সংগঠনটির

সদস্যরা। কেন এ ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ- জানতে চাইলে সংগঠনটির সিনিয়র সদস্য সাকিব হাসান ভোরের আকাশকে জানান, অনেক সময় দেখা যায়, ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকেই মানুষ খারাপ কাজে জড়িয়ে

পড়েন। এসব মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা কমিয়ে তাদের ভালো কাজে ধাবিত করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আমরা চেষ্টা করছি এরকম দরিদ্র মানুষকে দিয়ে ভালো কাজ করাতে। তাই এ খাবার বিতরণের

উদ্যোগ। কবে থেকে কার্যক্রম শুরু, জানতে চাইলে সাকিব জানান, মূলত ২০০৯ সালে বিশেষ কয়েকটি দিনে এ ধরনের আয়োজন হতো। পরে ২০১২ সাল থেকেই সপ্তাহে একদিন ভালো কাজের বিনিময়ে

আমরা খাওয়ানোর এ কার্যক্রম শুরু করি। তবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে প্রতিদিন খাওয়ানোর কার্যক্রম শুরু হয়।

এত লোকের খাবার জন্য যে বিপুল পরিমাণের অর্থের প্রয়োজন, তা কীভাবে আসে তা জানতে চাইলে তিনি জানান, এ সংগঠনে প্রায় ৮০০ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন। সদস্যদের থেকে প্রতিদিন ১০ টাকা

করে মাসে ৩০০ টাকা চাঁদা হিসেবে জমা নেওয়া হয়। এই চাঁদার টাকা থেকেই তারা প্রতিদিন মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় অনেকেই এককালীন আর্থিক সহযোগিতা করে

থাকেন। ভালো কাজের হোটেলের এ স্বেচ্ছাসেবক জানান, ‘যদি কোনো ব্যক্তি এসে বলে, তিনি আজ ভালো কোনো কাজ করেননি, এরকম কেউ থাকলে তাকেও খাবার দেওয়া হয়। কারণ ওই ব্যক্তি সত্য

কথা বলেছেন। সত্য বলাও একটি ভালো কাজ। খাবারের পাশাপাশি এ সময় আমরা তাকে পরদিন দুটি ভালো কাজ করার পরামর্শও দিয়ে থাকি।’ এখানে যারা আসেন, তারা মূলত কী ধরনের ভালো কাজ

করেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্ধ বা শিশুকে রাস্তা পারাপারে সহায়তা, রিকশা ভাড়া না নিয়ে অসহায় মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু; বিশেষ করে কাচের টুকরো,

ইটপাথর, পিন সরিয়ে ফেলা এবং কাঁধে বোঝা বহন করতে কষ্ট হলে সহায়তা করার মতো অনেক ভালো কাজ করেন অনেকে।

অপর এক স্বেচ্ছাসেবক এম এইচ অনিক বলেন, ক্ষুধামুক্ত সমাজ গঠন করা ও ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে খারাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে আনাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। তিনি আরো বলেন, এ কার্যক্রম আরো

বৃহৎ আকারে করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। মূলত আমরা এ কাজটি করি আত্মতৃপ্তির জন্য, নিজেদের ভালো লাগার জন্য।

মন্তব্য

Beta version