এক সময় শীতলক্ষ্যায় পালতোলা নৌকা চলত। কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে সেই ঐতিহ্য। ক্রমাগত দূষণ ও দখলে ক্ষীণ জলাধারে রূপ নিয়েছে শীতলক্ষ্যা। নদীখেকোদের যেন কোনোভাবেই নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। অবৈধ দখলদারেরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে দিন দিন।
উচ্ছেদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আবারো দখল হতে থাকে নদীর পাড় ও তীরবর্তী এলাকা। বর্তমান সরকারের আমলে এ নদীতে একাধিকবার অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হলেও অদৃশ্য ইশারায় আবারো দখল হয়ে গেছে তীরবর্তী এলাকা।
মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর ২৮ কিলোমিটারই এখন অবৈধ দখলে। নারায়ণগঞ্জ থেকে রূপগঞ্জ, ডেমরা থেকে সোনারগাঁও কোথাও খালি জায়গা নেই, যেখানে দখল হয়নি। এর পাশাপাশি তীরবর্তী শতাধিক শিল্প-কারখানার দূষিত শিল্পবর্জ্য মরণদশায় নিয়ে গেছে নদীটিকে।
রাজধানীর চারপাশ দিয়ে নদীগুলোই যেন ঢাকার লাইফ লাইন। ঢাকার জনপদকে সুরক্ষিত রাখা-নাগরিক সভ্যতা গড়ে ওঠার মূলেও এসব নদীর প্রবাহই রেখেছে প্রধান ভূমিকা। মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে প্রায় সব উপযোগিতাই হারিয়ে ফেলেছে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো।
জলাবদ্ধতা দূরীকরণে থাকা রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো এখন যেন জনসাধারণের কাজে আসছে না। জলাবদ্ধতার ভোগান্তি আরো বাড়ছে দিন দিন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নে এসব নদীর পানি স্বাভাবিক গুণাগুণ হারিয়ে ফেলেছে। সেই সঙ্গে অবাধে চলেছে নদী ভরাট, অপদখল এবং নদী বিনাশী নানা তৎপরতা। যেন নদী দখল ও দূষণের প্রতিযোগিতা চলছে।
নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, শীতলক্ষ্যা দখলদারমুক্ত করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নদী রক্ষায় কাঁচপুর সেতুর পাশে ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। জানা গেছে, মহামান্য হাইকোর্ট ২০০৯ সালের ২৫ জুন শীতলক্ষ্যাসহ ঢাকার চারপাশের নদীর সীমানা সিএস রেকর্ড অনুযায়ী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নির্ধারণের আদেশ প্রদান করলে নদীগুলোর সীমানা নির্ধারণে ৪ হাজার ৬৩টি পিলার বসানো হয়েছিল।
বিআইডব্লিউটিএর উচ্ছেদ অভিযানে ২০০৬ সালে ৪৪টি পাথর ও বালুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করা হয়। এরপর আর কাউকে কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দখলদারেরা আবারো নদী দখল করে বালুর ব্যবসায় মরিয়া হয়ে ওঠেন। নদীটির তীর ঘেষে রয়েছে শতাধিক শিল্প কারখানা।
এসব কারখানার দূষিত শিল্পবর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূষণ হচ্ছে শীতলক্ষ্যা। দুই তীরের ভয়াবহ দখলের কবলে খরস্রোতা এ নদীর কয়েকটি স্থানে খালের মতো সংকুচিত হয়ে গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, জরিমানা করেও নদীতে বর্জ্য ফেলা থেকে শিল্প মালিকদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না।
এবার নদী রক্ষায় দূষণের উৎসস্থলগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দূষণের সঙ্গে জড়িতদের একটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। শিল্প, নৌপরিবহণ, বন ও পরিবেশসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের কাছে তালিকাটি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে টাস্কফোর্স যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। জানা যায়, শীতলক্ষ্যা দূষণের জন্য দায়ী শিল্প-কারখানার বেশির ভাগেরই বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) নেই। কিছু প্রতিষ্ঠানের ইটিপি থাকলেও অনেক সময়ই তা বন্ধ থাকে। এতে পরিশোধন ছাড়াই শিল্পবর্জ্য গিয়ে পড়ছে শীতলক্ষ্যার পানিতে। নদীটি ঘিরে এমন অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে, যেগুলোর পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।
আবার যেসব কারখানার অবস্থান নদী থেকে দূরে, বর্জ্যনিষ্কাশন কাজে তারা ব্যবহার করছে পৌর ও সিটি করপোরেশনের নর্দমা। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যও মিশছে শীতলক্ষ্যায়।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শীতলক্ষ্যা দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম এসেছে নারায়ণগঞ্জ সল্ট, আজিমুদ্দিন ভূঁইয়া ট্রাস্ট, জামাল সোপ ফ্যাক্টরি, আমিন ব্রাদার্স জুট এন্ড কোং, প্যারিটি ফ্যাশন, পিএন কম্পোজিট, ইব্রাহিম নিটেক্স, সানি নিটিং, নিট কনসার্ন, ফ্লক প্রিন্ট, সিদ্দিক ফুড, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল, রেক্স নিট ওয়ার্ক, আরএজেড নিটওয়ার্ক, সোহাগপুর টেক্সটাইল মিলস ও প্রিতম ফ্যাশনেরও।
এ তালিকায় আরো আছে শিউল টাওয়েল ফ্যাক্টরি, ইব্রাহিম টেক্সটাইল, স্টার পার্টিকেল বোর্ড, আম্পর পাল পেপার মিল, কনিক পেপার মিল, মালেক জুটমিলস, কাঁচপুর ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, জয়া গ্রুপ ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, বেঙ্গল প্যাকেজেস, সোনালি পেপার মিলস, রহমান কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, শবনম ভেজিটেবল অয়েল মিলস, ক্রিস্টাল সল্ট, লিনা পেপার মিলস, অনন্ত পেপার মিলস ও জালাল জুট বলিং অ্যান্ড কোং।
এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু অংশের বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি থাকলেও তা বন্ধ রাখা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর একাধিক সূত্র বলছে, নদী দখল ও দূষণরোধে সরকার আন্তরিক। ঢাকা ও এর চার পাশের ১১৯ কিলোমিটার নদীকে আগের অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্ট তাদের পরীক্ষায় দেখিয়েছে, কাঁচপুর খাল এলাকায় শীতলক্ষ্যার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে দশমিক ১৮ মিলিগ্রাম। কাঁচপুর বিআইডব্লিউ টিএ টার্মিনাল এলাকায় এর মাত্রা দশমিক ১৯ মিলিগ্রাম, সাইলো এলাকায় দশমিক ১২, সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে দশমিক ১৯, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের কাছে দশমিক ৫১, পদ্মা পেট্রোলিয়াম এলাকায় দশমিক ৪২ ও আকিজ সিমেন্ট কারখানার পাশে দশমিক ৭৪ মিলিগ্রাম।
এ ছাড়া শীতলক্ষ্যার সিনহা টেক্সটাইল এলাকায় দশমিক শূন্য ২, স্ক্যান সিমেন্টের কারখানার পাশে দশমিক শূন্য ৮, পুষ্টি ভোজ্যতেল কারখানার পাশে দশমিক শূন্য ৩ ও ওয়াসা ইনটেক এলাকায় প্রতি লিটারে দ্রবীভূত অক্সিজেন পাওয়া গেছে দশমিক শূন্য ৪ মিলিগ্রাম।
যদিও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০০৭ অনুযায়ী, মৎস্য ও জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকার কথা ৫ মিলিগ্রামের বেশি। এছাড়া শীতলক্ষ্যার পানিতে ক্ষারের পরিমাণও বেশি বলে পবা ও ডব্লিউবিবির পরীক্ষায় উঠে এসেছে।
প্রতি লিটার পানিতে এর গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৭ পিএইচ ও এর কাছাকাছি হলেও শীতলক্ষ্যার প্রতিটি পয়েন্টেই এর মাত্রা ৮-এর বেশি। মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর থেকে মেঘনার শাখা এ শীতলক্ষ্যায় নারায়ণগঞ্জ ৫ নম্বর ঘাট থেকে সুলতানা কামাল সেতু পর্যন্ত দুই তীরে দখলের এ মহোৎসব তুলণামূলক বেশি।
সুলতানা কামাল সেতুর নিচে দুটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নদীর বিশাল জায়গা ভরাট করে বালুর ব্যবসা করছে। ব্রিজের দুই দিকে ৩০ ফুট জায়গায় কোনো কিছু রাখা নিষিদ্ধ থাকলেও দখলদারেরা এসবের তোয়াক্কা করছেন না তারা। এমনকি উচ্ছেদের জন্য প্রশাসনের লোকজন গেলে তারাও অনেক সময় হামলার শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি বলছেন, এলাকার ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের এক ডজন নেতার দোর্দণ্ড দাপটেই চলছে নদী দখলের মহোৎসব। ওই নেতাদের সমর্থক কিছু ব্যবসায়ী নদীর প্রবাহ বন্ধ করে ইট, সুরকি ও বালুর অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।
শীতলক্ষ্যার তীরে কোনো ধরনের ব্যবসার অনুমোদন না থাকলেও প্রকাশ্যে নদী ভরাট করে বাণিজ্য করছেন তারা। স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় এসব কার্যক্রম চলায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন অভিযুক্তরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ-৩ (সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের প্রভাবশালী কতিপয় ব্যাক্তি সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে চালাচ্ছেন শীতলক্ষ্যা নদীর দখল-বাণিজ্য। স্থানীয় এসব প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় কাঁচপুর ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় বসানো হয়েছে কয়েকটি পাথর ভাঙার মেশিন (ক্রাশার)।
এগুলোর ঝাঁকুনিতে ব্যস্ততম ব্রিজটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রূপগঞ্জের নদীর অংশে স্থানীয় শতাধিক ব্যক্তি অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। এ ছাড়া নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে কয়েকটি কল-কারখানা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে বলে তারা দাবি করলেও কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলো রক্ষার স্বার্থে বহু আন্দোলন হয়েছে। তাতে কোনো কাজ হয়নি।
আমরা সরকারকে সচেতন করতে পারি। পরামর্শ দিতে পারি, কিন্তু কাজ করার দায়িত্ব সরকারের। কাঁচপুরের জেলেরা জানায়, ময়লা-আবর্জনা ও মিল কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। এখন আর শীতলক্ষ্যা নদীতে মাছ পাওয়া যায় না। কারণ এই নোংরা ও বিষাক্ত পানিতে কোনো জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার সম্ভবনা থাকে না।
উল্লেখ্য, বর্তমানে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী দখলমুক্ত, পিলার স্থাপন এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণের একটি প্রকল্প চলমান আছে। এছাড়া ঢাকার চারপাশের নদী ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী দখলমুক্ত করতে ২০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মন্তব্য