সুনামগঞ্জ থেকে সড়কপথে অটোরিকশায় প্রায় তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী ‘সামারচর বাজার’। সেখান থেকে সুরমা নদীপথে ট্রলারযোগে প্রায় এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিলেই ছোট্ট বাজার, নাম ‘মামুদনগর নতুন বাজার’। বাজারে ওঠামাত্র স্বাগত জানাবে ‘ছায়ার হাওর’-এর সরু পাকা পথ। বৈশাখ চলছে। এখন কৃষকদের দম ফেলার ফুরসত নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ব্যস্ততা শুধু ফসল তোলা নিয়ে।
‘মামুদনগর’ গ্রামে তখন দুপুর ১২টা। রাস্তায় শুকানো হচ্ছে খড়। সড়কের দুই পাশে একের পর এক ধানের ‘খলা’। যেখানে হাওর থেকে কেটে আনা পাকা ধান মাড়াই-শুকানো হচ্ছে। নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে বাড়ির শিশুরা পর্যন্ত ফসল তোলার কাজে নিয়োজিত।
কেউ বারবার ধান উল্টাচ্ছেন, কেউবা খড় শুকাচ্ছেন। নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে গবাদিপশুর যত্ন করতে কেউ ভুলছেন না। তবে মাঝেমধ্যে কাজের ছন্দপতন ঘটায় আকাশের কালো মেঘ, বৃষ্টি আর বজ্রপাত। তাতে কী? ভেংচি কাটে কৃষক আর কিষানিরা। যেন দূর হয় সর্বনাশা দুর্যোগ।
বৈশাখ শেষ মানেই যেকোনো সময় ঝড়-বৃষ্টি। এজন্য এ অঞ্চলের মানুষের মানসিক প্রস্তুতি রয়েছে। তাই প্রতি খলাতেই আছে ধান ঢেকে রাখার জন্য বিলাশ বিশাল ‘ত্রিপল’। বৃষ্টির লক্ষণ দেখা দিলেই শুরু হয় দৌড়-ঝাঁপ। সবাই মিলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢেকে দেওয়া হয় এ অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল ধান। অনেকেই ধান শুকাতে মাঠে অস্থায়ী খড়ের ঘরও তুলেছেন। বাড়ি থেকে পাঠানো সকাল-দুপুরের খাবার খড়ে বসেই খান অনেক কৃষক।
এ দৃশ্য রাস্তার পাশ থেকে ছাপিয়ে হাওরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেখা যায়। এই গ্রাম ছাড়াও আশপাশের বেশ কিছু গ্রামজুড়ে যখন বোরো ফসল ঘরে তোলার উৎসব চলছে, ঠিক তখন একই হাওরের সুলতানপুরসহ আশপাশের গ্রামের মানুষের চোখে জল। বাঁধ ভেঙে গিয়ে ফসল ডুবির কারণে তারা এবার চোখের পানি নিয়েই ঈদ উৎসব উদযাপন করেছেন, কোনো আনন্দ ছাড়াই। অর্থাৎ একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে বিষাদের ছায়া। আর্তনাদ, আহাজারি।
প্রায় ছয় বছর পর একটি অন্যরকম ঈদ কাটাল হাওরপাড়ের মানুষ। যারা আকস্মিক বন্যায় কষ্টের একমাত্র ফসল হারিয়েছেন তারা একেবারেই বাকরুদ্ধ। স্তব্ধ। ঘরে কোনো আনন্দ নেই। নেই কারো মুখে হাসি। নেই তৃপ্তির ঢেকুর। তাদের মাথায় এখন মহা দুশ্চিন্তা। কপালে চাপের ভাঁজ।
একদিকে ঘরে ধান নেই, অন্যদিকে আগামী এক বছর কীভাবে সংসার চলবে সেই চিন্তা। তেমনি ধারদেনা বা এনজিও থেকে যারা ঋণ নিয়ে অনেক আশায় ফসল করেছেন তাদের চিন্তা আরো বেশি! আর্থিক টানাটানিতে অনেকেই এ বছর ছেলেমেয়ের পর্যন্ত ঈদের পোশাক কিনে দিতে পারেননি।
সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ আর নেত্রকোনা নিয়ে বিস্তৃত এই ছায়ার হাওর। তিনটি আন্তজেলার সমন্বয়ে এই হাওরের বেশির ভাগ জমিই সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায়। ছয় মে পর্যন্ত হাওরটির ধানকাটা প্রায় শেষ। এখন খড়গুলো হাওরের জাঙ্গালে, সড়কের পাশে গম্বুজাকৃতি করে আপাতত রেখেছেন কৃষকরা। যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘খড়ের লাছি’ বলা হয়। ধান গোলায় তোলার কাজ শেষ হলেই খড় আরো ভালোভাবে শুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে লাছি করে রাখবেন কৃষক। যে বাড়িতে লাছি দেওয়া হচ্ছে সেখানেই আয়োজন হচ্ছে ‘রাজহাঁস’ খাওয়ার।
গত মাসের ২৪ এপ্রিল সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরের ৮১ নং পিআইসির (মাউতির) বাঁধ ভেঙে হাজারো কৃষকের ফসল ডুবে যায়। এতে দিরাই, শাল্লা, নেত্রকোনার খালিয়াজুরী, মদন, কিশোগঞ্জের ইটনা ও মিঠামইন এলাকার কৃষকদের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যায়।
সরেজমিন দেখা গেছে, বিশাল এই হাওরের বেশিরভাগ ধান কেটে ঘরে তুলেছেন কৃষকরা। অর্থাৎ পুরো হাওর ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে তিন জেলার কিছু কিছু অংশের কৃষকরা একেবারেই মহাক্ষতির মুখোমুখি। অনেক কৃষক আছেন যারা এক চিমটি ধানও ঘরে তুলতে পারেননি।
কৃষকরা বলছেন, বর্ষার পানি নামার পর থেকে বোরো আবাদের ব্যস্ততা শুরু হয়। পুরো বছরের মধ্যে ছয় মাস কাজ, বাকি ছয় মাস মাছ ধরা বা বসে থাকা। ধান লাগানোর পর বৈশাখের শুরু থেকেই তাদের মনে আতঙ্ক দেখা দেয়। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হাওরপাড়ের একমাত্র এই ফসল। অতিবৃষ্টি, বন্যা, খড়া, পাহাড়ি ঢল, শিলা না হলে ধান ঘরে তোলা নিশ্চিত। গত কয়েক বছরে কোনো সমস্যা না হলেও এবার আগাম বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
সব কৃষের দাবি, প্রতি বছর ফসলরক্ষার বাঁধ নির্মাণ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এবারও তাই হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, জেলার সবচেয়ে বেশি যে হাওরে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে তার একটি ছায়ার হাওর। তাই দোষীদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।
সুনামগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২৩টি প্রকল্পের মাধ্যমে হাওরের ৫৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার করার কথা ছিল। বিভিন্ন এলাকয় ফসল ডুবির কারণে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে অনিয়ম- দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
জানতে চাইলে শাল্লা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট অবনি মোহন দাস বলেন, এই উপজেলায় বিভিন্ন হাওর পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পেছনে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম- দুর্নীতি একটি বড় কারণ। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটিও আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আমি চাই অপরাধীদের বিচার হোক। তারা যেন রাজনৈতিক কারণে অপরাধ থেকে মুক্তি না পায়। মুক্তি পেলে ভবিষ্যতেও কৃষকরা কাঁদবে, ফসল ডুববে। অপরাধীরা হাসবে।
এদিকে হাওর ডুবির পর পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আনামুল হক শামীম হাওরের বিভিন্ন এলাকা সফর করেছেন। মন্ত্রীর সামনেই স্থানীয় কৃষকরা বাঁধ নির্মাণে পুকুরচুরির চিত্র তুলে ধরে প্রতিকার দাবি করেন। এ ব্যাপারে মন্ত্রীর আশ্বাসের প্রেক্ষিতে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম তদন্তে একাধিক কমিটি গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদারের ‘বাংলাদেশের হাওর’ (২০২১) বইয়ের তথ্যানুযায়ী, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৭টি জেলার ৫০টি উপজেলার ১৪ হাজার ৫৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাওর অঞ্চল বিস্তৃত। এখানে ৪১৪টি হাওর আছে। এসব হাওরের অধিকাংশ স্থানে বোরো ফসল ফলান কৃষকেরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, হাওরের ৭টি জেলায় মোট বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমি। এর বিপরীতে ৯ লাখ ৫০ হাজার ৪০৬ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। তবে পরিপূর্ণভাবে হাওর এলাকায় আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫১ হাজার ১৯৬ হেক্টর জমিতে। এর বাইরে থাকা আবাদকৃত ৪ লাখ ৯৯ হাজার ২১০ হেক্টর জমি হাওরবহির্ভূত এলাকায় পড়েছে। হাওর অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত উঁচু ও সমতল জায়গায় অবস্থিত জমির ফসল হাওরবহির্ভূত বলে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
জানা যায়, উপজেলার ছায়ার হাওরে এ বছর শাল্লা অংশে ৪ হাজার ৬৩৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়। তাছাড়া কিশোরগঞ্জের ইটনা অংশে ও নেত্রকোনার খালিয়াজুরী অংশে প্রায় হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়।শাল্লা উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর অফিস সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত ছায়ার হওরে ৯৫ শতাংশ জমির ফসল কাটা হয়েছে।
ছায়ার হাওরপাড়ের সুলতানপুর গ্রামের কৃষক তকবির হোসেন বলেন, আমার মতো অনেক কৃষক এবার ক্ষতির মুখোমুখি। তাই ঈদ উদযাপনও ভালো হয়নি।
৪নং শাল্লা ইউপি চেয়ারম্যান মো. আব্দুস সাত্তার মিয়া জানান, হাওরের ফসল কোনো এলাকায় ক্ষতি হয়েছে, কোনো এলাকার মানুষ ভালোভাবে ফসল তুলতে পেরেছেন। যারা একমুঠো ধানও ঘরে নিতে পারেননি তাদের অনেক কষ্ট হবে। মামুদনগর গ্রামের কৃষক অমন চক্রবর্তী বলেন, আমাদের দিকে সব কৃষক ফসল তুলেছেন। সবাই রাত-দিন পরিশ্রম করে ধান শুকানোর কাজে ব্যস্ত। একই গ্রামের অপর কৃষক আলিম মিয়া জানান, বাঁধ ভেঙে ফসল ডুবির পেছনে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ বিস্তর। তদন্ত করে অপরাধীদের যেন বিচারের ব্যবস্থা করা হয়।
শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু তালেব বলেন, ছায়ার হাওরের ৯৫ শতাংশ জমির ফসল কাটা হয়েছে।
দেশের সবচেয়ে বেশি হাওর অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জ শহর থেকে সিলেট ও শাল্লার রাস্তার পাশে দিগন্তজোড়া ‘দেখার হাওর’। সত্যিই হাওরটি দেখার মতোই। এই হাওরে এখন ধান কাটা শেষ। কৃষকরা যখন ফসল তোলার প্রশান্তি নিয়ে ডেমি ধানের অপেক্ষায়। তখন একই উপজেলার পুঠিয়া ও কৌইয়া হাওরের মানুষের ফসল হারিয়ে মনের কষ্টের শেষ নেই।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ডুবে যাওয়া ছোট কানলার হাওরপাড়ের বিরামপুরের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম আপসোস করতে করতে করতে বলছিলেন, এবারের ঈদ উৎসব আমাদের হয়নি। যন্ত্রণার নদীতে আমরা ভাসছি। হাওরপাড়ে দাঁড়িয়ে একইভাবে হা-হুতাশ করছিলেন একই গ্রামের সুজাত মিয়া নামের আরেক কৃষক।
ফসল হারিয়ে হাওরপাড়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন ষাটোর্ধ্ব পারভিন বেগম। তিনি বললেন, ‘অখন বাইচ্ছা-কাইচ্ছা লইয়া খাইয়া বাঁচতাম কিলা’। স্থানীয় কৃষকদের দাবি, ছোট কানলার হাওরে দুই থেকে তিন শ হেক্টর জমি আছে। কোনো ধানই পাকেনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এবার সুনামগঞ্জের ৩২টি হাওর পানিতে তলিয়েছে। জেলায় পাঁচ হাজার ৭৫০ হেক্টর ধান নষ্ট হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় মানুষের বক্তব্য হলো, বাস্তবে ২০ হাজার হেক্টর জমির ধান বানের জলে গেছে। মন্ত্রণালয় বলছে, ২০ এপ্রিল পর্যন্ত হাওরের ৪১ ভাগ বোরো ধান কাটা হয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জে ৩৮ ভাগ, নেত্রকোনায় ৭৩ ভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৯ ভাগ, সিলেটে ৩৭ ভাগ, মৌলভীবাজারে ৩৬ ভাগ, হবিগঞ্জে ২৫ ভাগ এবং সুনামগঞ্জে ৪২ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর দেশের হাওরভুক্ত ৭টি জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জের হাওরে বোরো ধান আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার ১৩৮ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ৯ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির ধান অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে আক্রান্ত হয়েছে, যা মোট আবাদের শতকরা এক ভাগ।
মন্তব্য