ধরন পাল্টে যাচ্ছে বজ্রপাতের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সময়কে বজ্রপাতের সময় হিসেবে ধরা হতো।
জলাবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্ব উষ্ণায়ন বেড়ে যাওয়ার কারণে বজ্রপাতের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে।
এখন ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতের প্রকাপ থাকছে। এছাড়াও আগে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত আকাশ থেকে মাটিতে বজ্রপাত হতো।
যার কারণে মানুষের প্রাণহাণির ঘটনা বেশি ঘটে। আর বর্ষাকালে বজ্রপাত হতো আকাশ থেকে আকাশে। এই ধরনের বজ্রপাতে মানুষের জানমালের তেমন ক্ষতি হতো না।
কিন্তু সম্প্রতিক সময়ে বর্ষাকালেও আকাশ থেকে মাটিতে বজ্রপাতের ঘনঘটা বাড়ছে।
শুধু তাই নয় আগে বজ্রপাত হতো সাধারণত বিকালের দিকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে দিনে এবং রাতের যে কোনো সময়েই বজ্রপাত হচ্ছে।
প্রাণহানির সঙ্গে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও কম হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা যত বাড়বে বজ্রপাতের সংখ্যা এবং প্রাণহাণির ঝুঁকিও আরো বাড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান তৌহিদা রশিদ জানান, আগে বজ্রপাতের প্রকোপ থাকত মার্চ থেকে মে-জুন পর্যন্ত।
এখন দিনের যেকোনো সময় বজ্রপাত হচ্ছে এবং প্রকোপ থাকছে ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বজ্রপাত বহুগুণ বেড়ে গেছে। মার্চ থেকে শুরু করে নভেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতে প্রাণহাণির ঘটনা ঘটছে।
দেশের বজ্রপাত ভয়াবহ আকার ধারণ করায় ২০১৬ সালের সরকার এটিকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশে বছরে এখন প্রায় ৩০০ মানুষ বজ্রপাতে মারা যাচ্ছেন।
যদিও বজ্রপাত প্রতিরোধেরও ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।
সারাদেশে প্রায় ৪০ লাখ তালগাছ লাগানোর প্রকল্প হাতে নিলেও সম্প্রতি সেটি বাতিল করা হয়েছে। এর পরিবর্তে বজ্রপাত প্রতিরোধে বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তাদের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগ প্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম।
অপরদিকে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ বিপদাপন্নতায় পৃথিবীতে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। গত ১০ বছর সময়ের ব্যবধানে দেশে ১১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছেন।
গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের তথ্য মতে, বাংলাদেশে গত ২০ বছরে ১৮৫টি আবহাওয়াজনিত তীব্র দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের উষ্ণমণ্ডলীয় জলরাশির কাছাকাছি অবস্থান হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর তালিকায় সামনের দিকে রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত।
আগের চেয়ে ঘন ঘন তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পুনের ইনডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটিরিওলজির এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ায় ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু অংশে ‘শুষ্ক পরিস্থিতি’র উদ্ভব হয়েছে এবং অন্য অনেক এলাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃষ্টি বেড়েছে।
আবহাওয়াবিদরা জানান জলবায়ু পরিবর্তনে উষ্ণায়ন বেড়ে যাওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক স্থানে ‘বজ্রপাত ও অতিভারী বর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে।
ফলে আগাম বন্যা দেখা দিয়েছে, যা সম্প্রতি সিলেট অঞ্চলে হয়েছে। এছাড়াও একই কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে নদীর পানি বেড়ে যাওয়া এবং নদীভাঙনের ঘটনা ঘটছে।
গত রবিবারও বজ্রপাতে দেশর বিভিন্ন স্থানের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় বজ্রপাতে দুই ব্যক্তির মৃত্যু ও ছয়জন আহত হয়েছেন।
একই দিনে সকালে সদর উপজেলার লাবসা ইউনিয়নের দেবনগর মাঠে ও আগের শনিবার রাতে দেবহাটা উপজেলার নারকেলি গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়দের তথ্য মতে, রোববার সকালে দেবনগর মাঠে এস্কাভেটর মেশিন দিয়ে মাটি কাটছিলেন কয়েজন শ্রমিক। এ সময় বৃষ্টি ও বজ্রপাত শুরু হলে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার আগেই বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়। ছয়জন আহত হন।
শনিবার রাতে মাছের ঘেরে খাবার দেওয়ার সময় আকস্মিক ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে বজ্রপাতে একজনের মৃত্যু হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের প্রো-ভিসি ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, বজ্রপাত প্রতিরোধে আমাদের দরকার উঁচু গাছ।
আমরা নিজেরাই গাছ কেটে ফেলেছি। নিজেরাই নিজেদের বিপর্যয় ডেকে এনেছি।
মন্তব্য