বিতর্কিত নাসিম খানকে গুরুত্বপূর্ণ পদে পেতে সুপারিশ

মুরিদদের দুর্নীতির সুযোগ দেন গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী

নিজস্ব প্রতিবেদক
মুরিদদের দুর্নীতির সুযোগ দেন গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী
প্রকৌশলী শামীম আখতার (সংগৃহীত ফাইল ছবি)

যোগ্যতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতার চেয়ে তিনি বেশি প্রাধান্য দেন নিজের লোকদের। তিনি পীর হিসেবে নিজেকে জাহির করে মুরিদদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। সুযোগ দেন অনিয়ম, দুর্নীতির। এমন অভিযোগ গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারের বিরুদ্ধে।

এই অভিযোগ অবশ্য নতুন না। দেশের বিভিন্ন এলাকায় গণপূর্তের কাজে অনিয়ম, দুর্নীতিতে জড়িত শামীম আখতারের অনুসারীরা। শামীম আখতারের বিরুদ্ধে গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাজ কমিশনের মাধ্যমে পাইয়ে দেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। সম্প্রতি আরেক অভিযোগ যোগ হয়েছে এই প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে।

নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগে বিতর্কিত গণপূর্ত অধিদপ্তর (সংস্থাপন ও সমন্বয়) এর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নাসিম খানকে এবার আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চেষ্টা করছেন শামীম আখতার। যদিও দক্ষতার অভাব ও দুর্নীতির অভিযোগ যেমন নাসিম খানের বিরুদ্ধে রয়েছে, তেমনি রয়েছে রাজনৈতিকভাবে সরকারবিরোধী মেরুতে অবস্থানের অভিযোগ। এত কিছুর পর তাকেই চাচ্ছেন প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঢাকা মহানগরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। এই পদটি শূন্য হচ্ছে আগামী জুলাই মাসে। দায়িত্বরত প্রকৌশলীর অবসরজনিত কারণে এটি শূন্য হবে। এ পদে পদায়নের জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তর (সংস্থাপন ও সমন্বয়) এর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নাসিম খানকে পদায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করেছেন প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার। একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

সূত্র মতে, ঢাকায় সরকারি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো অভিজ্ঞতা নেই নাসিম খানের। ঢাকার বড় কোনো কাজে কখনো জড়িত ছিলেন না তিনি। বড় কোনো প্রকল্প সময়তো ও গুণগতমান বজায় রেখে বাস্তবায়নের বাস্তব ও কৌশলগত কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাকেই চাচ্ছেন শামীম আখতার। নাসিম খানের ছাত্র জীবন সম্পর্কে তথ্য রয়েছে সংশ্লিষ্টদের কাছে।

তিনি বুয়েটে অধ্যয়নকালে ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও প্রধান প্রকৌশলীর বুয়েটের বন্ধু ও মতাদর্শগত মিল থাকায় তাকেই সবকিছুতে প্রাধান্য দিচ্ছেন প্রধান প্রকৌশলী। বিষয়টি জানাজানির পর নাসিম খানের সঙ্গে নতুন করে বিতর্কে জড়িয়েছেন শামীম আখতার। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শবিহীন শামীম আখতারের প্রেরিত প্রস্তাবটি এবং সম্প্রতি দুজন উপসহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. ওবায়দুল হক ও মো. সেলিম তালুকদারকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে বরিশাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার সংস্থাপনা শীর্ষক প্রকল্পে সংযুক্ত করায় বিতর্কিত হচ্ছেন শামীম আখতার।

এ নিয়ে ইতোমধ্যে গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। শামীম আখতারের প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হবে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাসিম খান বর্তমান পদে থেকে বিভিন্ন শ্রেণির প্রায় দুই থেকে তিনশ’ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বদলি সংক্রান্ত বড়ধরনের আর্থিক লেনদেনে সরাসরি জড়িত বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৮৫ জন ভুয়া কর্মচারীর তালিকা দেখিয়ে বরিশাল গণপূর্তের একটি চক্রের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের পাঁয়তারার অভিযোগ উঠেছিল। ওই চক্রটি চাকরি দেওয়ার নাম করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। চক্রটি ৮৫ জন ভুয়া কর্মচারীর তালিকা প্রেরণের মাধ্যমে তাদের বিল-ভাতা উত্তোলনের অপকৌশল গ্রহণ করেছিল।

সূত্রমতে, ২০১৭ সালের ৯ মে গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সংস্থাপন) মো. নজিবর রহমান বরিশাল তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কাছে মাস্টাররোলে জনবল নিয়োগের আদেশ ও তারিখ চেয়ে একটি চিঠি প্রদান করেন। ওই আদেশ পেয়ে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে মাস্টার রোলে নিয়োজিত কর্মচারীদের তালিকা চান।

ওই সময় বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার মধ্যে পিরোজপুরে একজন মাস্টাররোলে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু ওই চিঠির প্রেক্ষিতে তৎকালীন ইএম উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আইয়ুব আলী ২৮ জন, মেডিকেল উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম ১২ জন, গৌরনদী সার্কেলের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাহিদ পারভেজ ২৪ জন ও গণপূর্ত উপ-বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোল্যা রবিউল ইসলাম ২১ জন কর্মচারী তাদের দপ্তরে দৈনিক ভিত্তিক নিয়োজিত রয়েছে বলে তালিকা প্রেরণ করেন।

এসব কর্মচারী ২০১৬ সাল থেকে কর্মরত রয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ না নেওয়ায় কর্মচারীদের এ দুর্নীতির পেছনে তৎকালীন ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলীদের জড়িত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ওই অনিয়মের ঘটনায় বিতর্কিত হন বরিশাল জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. নাসিম খান। যদিও তিনি পুরো বিষয়ে তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন।

নিজের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নাসিম খানকে এবার আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাচ্ছেন প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার। পীর হিসেবে পরিচিত এই শামীম আখতার। তিনি নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড়ের হাকিমাবাদ খানকা-ই-মোজাদ্দেদিয়ার পীর সাহেব। পীর হিসেবে তার নাম আল্লামা হযরত মোহাম্মদ শামীম আখতার। কম্বোডিয়াসহ দেশের কয়েক স্থানে রয়েছে এ খানকার শাখা। এই পীর নিজেকে স্বচ্ছ হিসেবে দাবি করেন। অথচ নিজের মুরিদরা গণপূর্ত অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। তারা বাস্তবায়ন করছেন মোটা অঙ্কের উন্নয়ন কাজ। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থা থেকে সুযোগ-সুবিধাও আদায় করে নিচ্ছেন তার মুরিদরা।

গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বের আগে মোহাম্মদ শামীম আখতার হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সেখানেও ঘটিয়েছেন অভিন্ন ঘটনা। কখনো কখনো প্রকল্প পাস না করে, কখনো টেন্ডার হওয়ার আগে কোটি কোটি টাকার উন্নয়নকাজ পেয়েছেন তার মুরিদ ঠিকাদাররা।

মাসে লাখ টাকা বেতনে তার লোকজন প্রকল্পের পরামর্শক, কর্মকর্তা-প্রকৌশলী থেকে বাবুর্চি-মালির মতো পদগুলোতে পান নিয়োগ। মুরিদদের সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন মহাপরিচালকের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে এইচবিআরআই থেকে একটি তদন্ত কমিটি। মুরিদদের ঠিকাদারিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদানসহ আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ জমা পড়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে এইচবিআরআইয়ে। হয়েছে তদন্তও।

২০১৯ সালের এপ্রিলে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই ‘নন ফায়ার ব্রিক প্লান্ট’ নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিংডম বিল্ডার্সের সঙ্গে চুক্তি করেছিল এইচবিআরআই। আইন অনুযায়ী, ১০ থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রকল্পের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু তার তোয়াক্কা করা হয়নি।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে এইচবিআরআইয়ের গবেষণা খাতে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। গবেষণা খাতের এ টাকা থেকে ১ কোটি ১১ লাখ টাকায় ‘অটোমেটিক ব্লক মেকিং প্লান্ট’ স্থাপন করা হয়। সেই কাজও পায় কিংডম বিল্ডার্স। কাজ শেষ না করেই বিল উত্তোলন করে নিয়ে যায় কিংডম। কোনো চুক্তি ছাড়াই একই প্লান্টের শেড নির্মাণের জন্য ৭০ লাখ টাকার কাজে কিংডম বিল্ডার্সকে নিযুক্ত করা হয়।

অর্ধকোটি টাকায় একই কাজ আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অর্থি এন্টারপ্রাইজকে দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা সবাই শামীম আখতারের মুরিদ হিসেবে পরিচিত। এসব তথ্যেও প্রমাণ রয়েছে এইচবিআরআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে। এবার শামীম আখতারের মুরিদ নাসিম খানকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চান তিনি।

এসব বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে, তার বিরুদ্ধে থাকতেই পারে। অভিযোগ মানেই বলা যাবে না যে তিনি দোষী। আমি অন্যায় কিছু করি না। অন্যায় কোনো কাজকে কখনো প্রশয় দেন না বলেও জানান তিনি।

মন্তব্য