-->

সওজের দুই প্রকৌশলীর এত সম্পদ!

* শতকোটি টাকার সম্পত্তি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামাল উদ্দীনের * নিজ বিভাগে বিএনপিপন্থি ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি তাদের

নিজস্ব প্রতিবেদক
সওজের দুই প্রকৌশলীর এত সম্পদ!

ঢাকা: রাজধানীর বনশ্রী সোসাইটিতে আটতলা আলিশান বাড়ি। অভিজাত হিসেবে পরিচিত একই এলাকায় আরেকটি সুরম্য ফ্ল্যাট। এর বাইরে রাজধানীতে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা। এখানেই শেষ নয়, যশোর-নড়াইল সড়কে রয়েছে ৩০ একর জমি। বেগমপাড়া হিসেবে খ্যাত কানাডার টরন্টোয় নিজের বাড়ি। সেখান থেকে প্রতি মাসে ভাড়া পান প্রায় ৩ লাখ টাকা! এতসব সম্পদের মালিক সরকারি একজন প্রকৌশলী। বলছি চট্টগ্রাম জেলা সড়ক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামাল উদ্দীনের কথা।

 

অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান বাজারমূল্য বিবেচনায় তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় শতকোটি টাকা। অথচ ষষ্ঠ গ্রেডে তার বেসিক বেতনকাঠামো ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা। তবে তিনি প্রতি মাসে বেতন পান ৮০ হাজার টাকার কাছাকাছি। এ বিবেচনায় তার আয়ের থেকে সম্পদের পরিমাণ বেশি! তা ছাড়া প্রতি মাসে ৮০ হাজার টাকা বেতন হিসাবে বোনাসসহ বছরে আয় প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টাকা। এ হিসাবে সপদে থেকে ৩০ বছরে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত তার মোট আয় দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। অথচ চাকরির অর্ধেক মেয়াদেই সড়ক ও জনপথ বিভাগের এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

 

তবে তার অর্জিত সম্পদের সবকিছুই নিজ নামে নয়। নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। নিজ, পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের নামে এসব সম্পদ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ায় সড়ক বিভাগেও তাকে নিয়ে আলোচনা বিস্তর। নিজ বিভাগেই তিনি ‘মিস্টার টেন পার্সেন্ট’ হিসেবে বহুল পরিচিত একজন কর্মকর্তা। বিএনপিপন্থি কর্মকর্তা হিসেবেও সওজে যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে তার। এখানেই শেষ নয়, তার কর্মস্থল চট্টগ্রাম হলেও স্ত্রী ও সন্তানরা থাকেন রাজধানীর বনশ্রীতে। এ সুবাদে তিনি কারণে-অকারণে ঢাকায় থাকেন বেশি। তার স্থায়ী ঠিকানা যশোরের কোতোয়ালি থানার ঝুমঝুমপুর গ্রামে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রজীবনে বুয়েটে পড়ার সময় তিতুমীর হল শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এ জামাল উদ্দীন। এ কারণে তিনি প্রায়ই সড়ক বিভাগে কর্মরত বিএনপিপন্থি কর্মকর্তাদের নিয়ে রাজধানীর তেজগাঁও লিংক রোডের একটি রেস্টুরেন্টে বৈঠক করেন। জামাল উদ্দীনের শ^শুরবাড়িও যশোরে। শ^শুরবাড়ির সবাই বিএনপিপন্থি। তার শ^শুর বিএনপির সমর্থনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।

 

তার সঙ্গে বিএনপির অন্যতম শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। ২০১৪ সালে তিনি তারেক রহমানকে প্রায় ৬ কোটি টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখানেই শেষ নয়, সড়ক বিভাগের উচ্চপর্যায়ে; এমনকি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও জামাল উদ্দীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শুধুই জামাল উদ্দীন নন, চট্টগ্রাম জেলা সড়ক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এস এম শাহরিয়ারের নামে-বেনামে ঢাকা-ফরিদপুর ও বরিশালে অসংখ্য প্লট, ফ্ল্যাট ও জমির মালিকানার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জামাল উদ্দীন ও শাহরিয়ারের অবৈধ সম্পদের একটি তালিকা এসেছে ভোরের আকাশের হাতে।

 

জামাল উদ্দীনের সম্পদের তালিকা ধরে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রামপুরার বনশ্রীর ৪ নম্বর সড়কের এফ-ব্লকে, ১৩ নম্বর বাড়িটি তার। নির্মাণাধীন আটতলা বাড়ির পুরো কাজ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এখন প্লাস্টার আর ইন্টেরিয়র ডিজাইন, পাইপলাইন ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ চলমান।

 

জানা গেছে, তিনি ২০১৬ সালে এ বাড়িটি সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরুর কাছ থেকে কিনেছেন। চতুর জামাল উদ্দীন বাড়িটি তার শাশুড়ির নামে রেজিস্ট্রি করান বলে জানা গেছে। বাড়িটির তত্ত্বাবধায়ক গোলাম মাওলা বলেন, ‘আমার জানা মতে, বাড়িটির মালিক জামাল উদ্দীন। তিনি চট্টগ্রামে সড়ক বিভাগে সরকারি চাকরি করেন। তবে তিনি এখানে আসেন খুবই কম। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতে আসেন না।

 

তবে পরিবারের অন্য লোকজন এখানে মাঝেমধ্যেই আসেন বলে জানান তিনি।’ গোলাম মাওলা জানান, ‘আমি শুরু থেকেই বাড়িটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছি। লোক মারফত বাড়ি নির্মাণের টাকা পাঠানো হয়। এভাবেই কাজ চলছে। কাজ শেষে বাড়িটি ভাড়া দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।’ এ ছাড়া বনশ্রীর বি-ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের ৩৭ নম্বর বাড়িতে থাকে জামাল উদ্দীনের পরিবার। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘বায়তুল হোসাইন নূর’ নামের এ ভবনের চারতলার জে-চার নম্বর ফ্ল্যাটটি তার নিজের টাকায় কেনা।

 

তবে বাড়ির কেয়ারটেকারের দাবি জামাল উদ্দীনের পরিবার এখানে থাকলেও ফ্ল্যাটটি মূলত কেনা নয়, ভাড়া। এখানে জামাল উদ্দীন প্রায়ই আসেন। তার সন্তানরা বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেন বলেও জানা গেছে।

 

অভিযোগ আছে, রাজধানীর আফতাবনগর এম-ব্লকের ২ নম্বর রোডে একটি ও জে-ব্লকের ৩ নম্বর সড়কে আরেকটি প্লটসহ ধানমন্ডির ১৫ নম্বরে ২টি, ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে ২টি, কল্যাণপুরে ১টি, লালমাটিয়ার জাকির হোসেন রোডে ২টি, মিরপুর মাজার রোডে ১টি, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরের ডান পাশে ২টি, গুলশান ১ নম্বর গোলচত্বরের বাম পাশের পোস্ট অফিসের কাছে ১টি, বনানী জে-ব্লকের ১৮ নম্বর রোডে ১টি, উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কে ১টি ফ্ল্যাট এবং যশোর নড়াইল মহাসড়কের পাশে ৩০ একর জমি রয়েছে। দেশের বাইরে কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়ায়ও জামাল উদ্দীনের বাড়ি থাকার অভিযোগ মিলেছে। সেখানে তার একটি সুরম্য বাড়ি রয়েছে, যা থেকে তিনি প্রতি মাসে ৩ হাজার কানাডিয়ান ডলার ভাড়া পান বলে জানা গেছে।

 

এ বাড়িটি তিনি সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জর্জেস হোসেনের মাধ্যমে ২০১৮ সালে কেনেন। বাড়িটি জর্জেস হোসেনের বাড়ির পূর্ব পাশে অবস্থিত বলে জানা গেছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামাল উদ্দীনের কর্মস্থল চট্টগ্রাম হলেও তিনি প্রায়ই ঢাকার বাসায় অবস্থান করেন এবং তার দুই নিকটাত্মীয়র মাধ্যমে শেয়ার ব্যবসা পরিচালনা করেন বলে জানা গেছে। একটি ব্রোকারেজ হাউসে শেয়ার ব্যবসার জন্য তার প্রায় ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে।

 

এসব অভিযোগের বিষয়ে জামাল উদ্দীনের বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগ করার পরও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তার মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা পাঠানোর পর ফোন ধরলেও এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি নিজ দপ্তরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যেকোনো বিষয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো কথা বলব না। স্যারের সঙ্গে কথা বলুন।’

 

সম্পদ অর্জনে পিছিয়ে নেই শাহরিয়ার : ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলির বাসিন্দা চট্টগ্রাম জেলা সড়ক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এস এম শাহরিয়ার। ড. আব্দুস সালাম চৌধুরীর সন্তান তিনি। শহরের ‘ফুলসুট’ ভিলায় তাদের স্থায়ী বসবাস। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিজ দপ্তরে শাহরিয়ার আপদমস্তক একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং মিস্টার ১৫ শতাংশ হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর ফরিদপুরের এক আত্মীয়ের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন এবং তার নাম ভাঙিয়ে অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। প্রকৃত অর্থে বিএনপি মতাদর্শী একজন কর্মকর্তা তিনি।

 

সরকারের একজন কট্টর সমালোচক হলেও নিজেকে ফরিদপুরের বাসিন্দা বলে এ পরিচয়ে আওয়ামী লীগের সুবিধা নেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ কর্মকর্তার খুলনা শহরে ১৪টি, ফরিদপুর শহরে ৫টি ফ্লাট, ঢাকার মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধের পূর্বপাশে ৬ নম্বর রোডের ৫ নম্বর হাউস (১টি ছয়তলা সুরম্য বাড়ি), বরিশাল-পটুয়াখালী রোডে টিয়াখালীতে ২২ একর জায়গার ওপর ‘চৌধুরী ফিশারি’ নামের একটি বিশাল মৎস্য খামার, খুলনা-সাতক্ষীরা মূল সড়কের পাশে জিলেরডাঙ্গায় ৯৪ একর জায়গায় ২টি ‘চৌধুরী চিংড়ি মাছের ঘের’ রয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে জানতে তার সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

 

ভোরের আকাশ/জেএস/

মন্তব্য

Beta version