-->
শিরোনাম
প্রেমিক থেকে জল্লাদ

বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনিকে ফাঁসিতে ঝোলান যিনি

রুদ্র মিজান
বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনিকে ফাঁসিতে ঝোলান যিনি
সানোয়ার শেখ। ছবি- ভোরের আকাশ

ছিলেন প্রেমিক। তারপর হত্যা মামলার আসামি। ঠিকানা হয় কারাগার। কারাবাসকালে জোটে  আরেক তকমা, জল্লাদ! শব্দটি শুনলেই আঁতকে ওঠে মানুষ। জল্লাদ হিসেবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আটজনকে বধ করেছেন তিনি। এর মধ্যে পাঁচজনই হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারী।

আলোচিত এই জল্লাদের নাম সানোয়ার শেখ। সানোয়ারের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার চাপ্তা গ্রামে। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর ওই গ্রামেই বসবাস করছেন সানোয়ার। ৫৪ বছর বয়সে বিয়ে করে সংসার করছেন। এক সন্তানের জনক সানোয়ার ধর্মকর্ম ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত। চাকরি করছেন নিজ বাড়ির পাশের একটি মাদ্রাসায়।

সম্প্রতি সানোয়ার শেখের সঙ্গে কথা হয় তার নিজ বাড়িতে। বাড়ির সামনে উপজেলা সদরের রাস্তা। পুকুর। তারপর একটি টিনশেড ঘর। এই ঘরেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন সানোয়ার শেখ। বাড়ির পাশে ধানি জমি।

১৯৬৩ সালে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জন্ম সানোয়ার শেখের। বাবা আব্দুল আজিজ শেখ ও মা মনোয়ারা বেগম। সহজ-সুন্দর জীবনযাপন করছিলেন সানোয়ার। স্বপ্ন ও প্রেমময় জীবনই ছিল তার। তিনি ভালোবাসতেন, স্বপ্ন দেখতেন। ছিলেন প্রেমিক। কিন্তু প্রেমিক থেকে আইনের কাছে হয়ে যান খুনি।

সানোয়ারের বয়স তখন ২৩ বছর। টগবগে সানোয়ার মনের অজান্তেই ভালোবেসেছিলেন পাশের গ্রামের এক তরুণীকে। মনের মানুষকে বিয়ে করে সংসার সাজানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তিনি। তবে সানোয়ারের প্রিয়তমাকে চাইতেন স্থানীয় এক প্রভাবশালীও। ত্রিভুজ প্রেমকে ঘিরে শুরু হয় সানোয়ার আর ওই প্রভাবশালীর শীতল যুদ্ধ।

১৯৮৯ সালের ৬ জুন আইয়ুব আলী নামের এক ব্যক্তি খুন হন। আসামি করা হয় সানোয়ারকে। ওই বছরের ৩০ জুন গ্রেপ্তার করা হয় সানোয়ারকে। কারাবন্দি অবস্থায় তাকে বেশ কয়েকবার দেখতে গিয়েছিলেন প্রেমিকা। কিন্তু সানোয়ার জানেন, তার মুক্তি মিলবে না সহজে। ফাঁসিও হতে পারে। তাই ফিরিয়ে দেন।

জানিয়ে দেন, তুমি আমার অপেক্ষায় থেকো না। একপর্যায়ে হত্যা মামলায় ৩০ বছর ও অপর একটি অস্ত্র মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড হয় সানোয়ারের।

প্রথম তিন বছর কাটে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারেই। ১৯৯২ সালের ১৩ মে সানোয়ারকে গোপালগঞ্জ থেকে আনা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ২০১০ সাল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি সানোয়ারকে প্রস্তাব দেওয়া হয় জল্লাদের দায়িত্ব পালনের। এর আগেও তাকে একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।

একজন প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিকে বধ করার মধ্য দিয়ে সাজা কমবে তিন মাস। কিন্তু এই দায়িত্ব পালন করতে তখন রাজি হননি তিনি। তখন ফিরিয়ে দেন প্রস্তাব। কিন্তু এবার ঘটে ভিন্ন ঘটনা। চেতনায় প্রজ্বলিত হয় একটি নাম বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তাব এটি। মুহূর্তেই রাজি হয়ে যান সানোয়ার শেখ। নিজ আগ্রহেই সেদিন জল্লাদের খাতায় নাম লেখান তিনি।

এর আগেও সাংবাদিক নিজামউদ্দিনের কন্যা শারমিন রীমা হত্যার আসামি মনির হোসেনের দণ্ড কার্যকরসহ বেশ কয়েক জনের ফাঁসি কার্যকরে অংশগ্রহণের প্রস্তাব পেয়েছিলেন সানোয়ার। কিন্তু এসব প্রস্তাবে সাড়া দেননি তিনি।যখনই শুনলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির কথা, তখন তার চোখে ভাসছিল বঙ্গবন্ধুর ছবি। শিশু রাসেলের নিষ্পাপ চেহারা।

২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ ও এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকরে জল্লাদের দায়িত্ব পালন করেন সানোয়ার। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ফাঁসি কার্যকরেও অংশ নেন সানোয়ার শেখ।

বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসিও কার্যকরেও অংশ নেন এই সানোয়ার শেখ। এই আটজনের ফাঁসি কার্যকরে অংশ নিয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবানই মনে করেন কারাগারে জল্লাদের দায়িত্ব পালনকারী সানোয়ার শেখ।

দীর্ঘ কারাভোগের পর ১৯১৭ সালের ১১ ডিসেম্বরে প্রায় ২৮ বছর পর কারাগার থেকে মুক্তি পান সানোয়ার শেখ। মুক্ত সানোয়ারের সঙ্গে তকমা জোটে জল্লাদ। তবে জল্লাদ সানোয়ারকে নিয়ে নেতিবাচক কোনো ধারণা নেই তার পরিচিতদের, স্বজনদের। বরং তাকে ভালোবাসেন কাশিয়ানীর লোকজন।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোল্লা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি দিয়েছে সানোয়ার। যে কারণে আমরা তাকে নিয়ে গর্ব করি।’

মুক্ত জীবনে ৫৩ বছর বয়সে সোনালী বেগমের সঙ্গে বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। সুখের সংসার। তিন বছর বয়সী হামিম শেখ নামে একটি পুত্রসন্তান রয়েছে এই দম্পতির। সোনালী বেগম জানান, বিয়ের আগে ভয় ছিল। সানোয়ারকে নিয়ে ভয়ংকর গল্প শুনেছেন তিনি। বিয়ের পর ধারণা পাল্টে গেছে। তার মতে, সানোয়ার একজন ভালো মনের মানুষ।

সংসার, সবুজে ঘেরা বাড়ি। ছোট্ট ঘর। ঘরের পাশে জমি। এসব নিয়ে দিন কাটে তার। এর মধ্যেই কারাবন্দি জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চাকরি করছেন সানোয়ার। স্থানীয় কুসুমদিয়া হযরত নূরশাহ ইসলামিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসায় রান্না-বান্নার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কারাগারেই শিখেছেন রান্নার কাজ। বাইসাইকেল চালিয়ে বাড়ির অদূরে ওই মাদ্রাসায় ছুটে যান।

মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও এতিম শিশুদের কাছে প্রিয়মুখ সানোয়ার। সংসারের কাজ ও চাকরি আর ইবাদাতের মধ্য দিয়েই দিনাতিপাত করছেন সানোয়ার শেখ। সানোয়ার বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের খুনি এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিতে পেরে আনন্দিত।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছে আছে বলে জানান সানোয়ার।

মন্তব্য

Beta version