-->
শিরোনাম

পুরান ঢাকায় সীমিত পরিসরে হালখাতা উৎসব

শিপংকর শীল
পুরান ঢাকায় সীমিত পরিসরে
হালখাতা উৎসব

‘হালখাতা’ বাঙালির অনন্য ঐতিহ্য। ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ‘ফসলি সন’ নামে। ধীরে ধীরে তা পরিচিত হয় ‘বঙ্গাব্দ’ হিসেবে। অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতাকে ঘিরে। গ্রাম-গঞ্জ-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের শুরুতেই পুরোনো হিসাব-নিকাশ শেষ করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন।বাঙালির যে কোনো মিলনমেলা উৎসবের রঙ মাখে অবলীলায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ উৎসব কিছুটা মলিন হলেও সর্বজনিন উৎসব হিসেবে হালখাতা বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ। এক সময় অর্থনৈতিক কর্মকা-ে হালখাতার সামাজিক গুরুত্বও ছিল ব্যাপক। বছরের প্রথম দিন ব্যবসায়ীরা তাদের পুরোনো বছরের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে নতুন খাতা খোলেন।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী দেনা শোধ করে দোকানি বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে মিষ্টিমুখে সম্মানিত হওয়ার বিষয়টি ছিল ভোক্তাদের কাছে মর্যাদার। বিষয়টি এতই প্রাণবন্ত ছিল যে, ভোক্তারা বকেয়া শোধ করে হালখাতায় অংশগ্রহণ করতে পারলে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করতেন তারা। তবে এবার রমজান মাসে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ায় তা বড় পরিসরে না হয়ে সীমিত আকারে রাজধানীর পুরান ঢাকায় হালখাতা অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানান সেখানকার ব্যবসায়ীরা। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য হালখাতা প্রথাটি আগের মতো চোখে পড়ে না। রাজধানীর পুরান ঢাকায় বাঙালির ঐতিহ্যগত এই প্রথা চোখে পড়লেও তা আগের মতো জমজমাটভাবে হয় না।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর পুরান ঢাকা ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হালখাতা উৎসব আয়োজনে ক্রেতাদের কাছ থেকে এখন আর আগের মতো সাড়া মিলে না। ব্যস্ত নগরজীবনের জাঁতাকলে ভোক্তারা দোকানে আসার তেমন সুযোগ পান না। অনেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জরুরি পাওনা পরিশোধ করেন।সীমিত পরিসরে হালখাতা উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও আপ্যায়নের কোনো কমতি নেই বলে জানান পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের স্থানীয় বাসিন্দা শতাব্দী দাশ। তিনি বলেন, সকাল থেকে পরিচিত তিনটা দোকানে গেছি প্রতিটি দোকানে মিষ্টিমুখ না করিয়ে ছাড়েনি। সঙ্গে পরিবারের সবার জন্য প্যাকেটের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি আরো বলেন, রমজানের কারণে সীমিত পরিসরে হালখাতা উৎসব পালিত হলেও এখানে আপ্যায়নের কোনো কমতি নেই। ব্যবসায়ীরা সাধ্যমতো সবাইকে আপ্যায়ন করাচ্ছেন।

পুরান ঢাকার ইসলামপুরের অঞ্জলী জুয়েলার্সের মালিক মদন পাল বলেন, প্রতি বছর এখানে নিয়ম মেনে বড় পরিসরে হালখাতার আয়োজন করা হতো। এবার রমজান হওয়ায় তা সীমিত আকারে করা হচ্ছে। দুই বছর করোনা মহামারির কারনে এখানকার ব্যবসায়ীদের অবস্থা তেমন একটা ভালো না। তাই সবাই যার যার সাধ্যমতো এ উৎসব পালন করছেন।

অনন্যা জুয়েলার্সের ম্যানেজার প্রবীর বণিক বলেন, আমরা এবার হালখাতার উৎসবে ৪০০ মানুষের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছি। স্বাভাবিক সময়ে আমরা ৭০০ থেকে ৮০০ মানুষের অ্যাপায়নের ব্যবস্থা করতাম।

পুরান ঢাকার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বছরে বছরে হালখাতার উৎসাহ-উদ্দীপনা অনেকটাই কমে গেছে। এখন কম্পিউটারের মাধ্যমে হিসাব করার ফলে লালসালুতে বাঁধাই করা হিসাব খাতার চল অনেক কমে গেছে। তাই অনেকটা নিয়ম রক্ষার জন্যই হালখাতার আয়োজন করেছেন ব্যবসায়ীরা।তাঁতীবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা সাগর বসাক বলেন, পুরান ঢাকায় উৎসবমুখর পরিবেশে হালখাতা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। তবে এবার সব দোকানে হালখাতা উৎসব হচ্ছে না। আয়োজকরা হিন্দু, মুসলিম সবার কথা মাথায় রেখে আয়োজন করেছে।

পুরান ঢাকায় শুক্রবার নতুন বছর উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের টালিখাতা মন্দিরে প্রতীমার পায়ে স্পর্শ করাতে দেখা গেছে। খাতায় পূজারির হাত দিয়ে গণেশ ঠাকুরের নামও লেখাচ্ছেন তারা। সেখানে অলিগলি ঘুরে দেখা যায়, সনাতন ধর্মালম্বীদের দোকানগুলোতে ধর্মীয় রীতি অনুসারে গণেশ পূজার মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছে হালখাতা। পূজারিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন, দোকানে দোকানে দিচ্ছেন পূজা।তাঁতীবাজারের পূরবী জুয়েলার্সের মালিক মনিন্দ্র নাথ বলেন, আজকের দিনটা অত্যন্ত আনন্দের, খুশির দিন। এই দিনে ধর্মের কোনো ভেদাভেদ নেই। পুরাতন বছরের সব কিছু ভুলে গিয়ে আমরা একে অপরে হালখাতা উদযাপন করছি। হালখাতায় ধর্মীয় উৎসবের মতো আনন্দ পাচ্ছি।এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো পুরোনো সব দেনা-পাওনা পরিশোধ করা। দোকান সাজিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে ক্রেতাদের। ব্যবসার হিসাব-নিকাশে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার হলেও রাজধানী ঢাকার কিছু এলাকায় রয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী এ হালখাতা।পুরোনো রেওয়াজ-রীতি মেনে মুসলমান ব্যবসায়ীরা দোয়া-মোনাজাত আর সনাতন ধর্মাবলম্বীরা গণেশ পূজার মধ্য দিয়ে হালখাতার আয়োজন করেছেন। খরিদ্দারের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে দিনভর চলে এই হালখাতা।পহেলা বৈশাখের দিন রাজধানীর তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার এবং ইসলামপুরে দেখা যায়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কীভাবে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে চলে লেনদেন ও কোলাকুলির মাধ্যমে কুশল বিনিময়।আয়োজনে থাকছে রসগোল্লা, কালোজাম, সন্দেশ, বাতাসা, ম-া, জিলাপি, লুচি, বুন্দিয়া, লাচ্ছা সেমাই, সুজি, হালুয়া, মুড়ি মুড়কি, দই, চিঁড়া, ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ, গোশত, মাছের মুড়িঘণ্ট, শরবত, বৈশাখী ফল আর খাওয়া শেষে মিষ্টিপান। অনেক সময় দোকানের সামনেই কারিগররা নতুন চুলা বসিয়ে তৈরি করেন গরম গরম জিলাপি, লুচি, বুন্দিয়া আর রসগোল্লা।তাঁতীবাজারের অন্যনা জুয়েলার্স, দি কিং গোল্ড, পুষ্পিতা জুয়েলার্স, মদন-মোহন গোল্ড হাউস, শাঁখারীবাজারে শিল্পী জুয়েলার্স, রাধা-গোবিন্দ জুয়েলার্স, দূর্জ স্বর্ণ শিল্পালয়, আমিন গোল্ড হাউস, পল্লবী গোল্ড হাউস, অমিত জুয়েলার্স, শরীফ জুয়েলার্স, সোনার বাংলা গোল্ড হাউসসহ ইসলামপুরের বস্ত্র ব্যবসায়ী, বাংলাবাজারের পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতি সীমিত পরিসরে হালখাতা উৎসবের আয়োজন করেছে।

হালখাতার ইতিহাস : সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল থেকেই হালখাতা পহেলা বৈশাখের আচার অলংকার হিসেবে বিবেচিত। হালখাতার পাশাপাশি জমিদারকে খাজনা প্রদানের অনুষ্ঠান হিসেবে ‘পুণ্যাহ’ প্রচলিত ছিল। নববর্ষের প্রথম দিন প্রজাকুল সাধ্যমতো ধোপদুরস্ত পোশাকে সজ্জিত হয়ে জমিদারবাড়িতে গিয়ে খাজনা পরিশোধ করে মিষ্টিতে আপ্যায়িত হতো। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ায় পুণ্যাহ এখন বিলুপ্ত হয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতিতে ব্যবসায়ীরা হালখাতার সমৃদ্ধ ইতিহাস ছোট আকারে হলেও আজো পালন করে চলেছেন।

মন্তব্য

Beta version