ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আবদুল্লাহ: ঘুষ খাওয়া, ঘুষ দেয়া ও ঘুষ নেয়া সামাজিক ব্যাধি। সমাজের প্রতিটি রন্দ্রে বিরাজমান। ঘুষের টাকা খেয়ে এবাদত করলে তা কবুল হয় না এমকি কোরবানি হয় না। ঘুষ মানুষের ঈমানকে নষ্ট করে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি করে। পবিত্র কোরআনের সূরা নাহলে (আয়াত-৯৫-৯৭) আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর অঙ্গীকারের বিনিময়ে সামান্য মূল্য গ্রহণ করবে না। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে যে পুরস্কার রয়েছে, তা অতি উত্তম তোমাদের জন্য যদি তোমরা জ্ঞানী হও।
তোমাদের কাছে যা আছে, তা নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং আল্লাহর কাছে যা আছে, কখনো তা শেষ হবে না। যারা সবুর করে, আমি তাদের প্রাপ্য প্রতিদান দেব। এটা তাদের উত্তম কর্মের প্রতিদানস্বরূপ- যা তারা করত। যে সৎকর্ম সম্পাদন করে, সে ঈমানদার পুরুষ হোক কিংবা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবনী শক্তি দান করব এবং প্রতিদানে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরস্কার দেব।’ তাই অন্যায়ভাবে অর্থ গ্রহণ ও খিয়ানত মারাত্মক অপরাধ।
যে ব্যক্তি পরকালের বিনিময়ে পৃথিবী গ্রহণ করে, সে অত্যন্ত লোকসানের কারবার করে। কারণ অনন্তকালের স্থায়ী এবং উৎকৃষ্ট নিয়ামত ও ধনসম্পদকে ক্ষণস্থায়ী ও নিকৃষ্ট বস্তুর বিনিময়ে বিক্রি করা কোনো বুদ্ধিমান লোক পছন্দ করতে পারে না। যে কাজ সম্পন্ন করার জন্য কারো কাছ থেকে বিনিময় গ্রহণ করা এবং বিনিময় না নিয়ে কাজ না করার অর্থই আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করা। তেমনিভাবে যে কাজ না করা তার কর্তব্য কারো কাছ থেকে বিনিময় নিয়ে তা সম্পাদন করাও আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গেরই নামান্তর। কাজেই এতে বোঝা যায়, সব রকম উৎকোচ ও ঘুষ আল্লাহর অপছন্দনীয় ও হারাম।
যে কাজ করা কারো দায়িত্ব অর্পিত, তা সম্পাদনের জন্য অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা অথবা যে কাজ তার না অথচ তা বাড়তি কিছু গ্রহণ করে সেটা সম্পাদন করাই হচ্ছে উৎকোচ বা ঘুষ। সূরা বাকারাহ (আয়াত-১৮৮) আল্লাহ বলেন, ‘এবং তোমরা একে অন্যের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে রেখো না এবং সেটা বিচারকদের কাছে উপস্থাপিত করো না, জেনে-শুনে লোকের সম্পত্তির কিছু অংশ অন্যায়ভাবে খাবার ইচ্ছায়।’ এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান, জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে ঘুষ গ্রহণ করাই আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা। আর আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারীর শাস্তি জাহান্নাম।
সূরা বাকারাহ (আয়াত-২৯-৩০) আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘হে মুমেনগণ।
তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে কারবার (ব্যবসা) ব্যতীত তোমরা অন্যের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে ভোগ করো না ও নিজেদের মধ্যে খোনাখুনিও করো না।... আর যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি ও অত্যাচার দ্বারা এটা করে আমি অবশ্যই তাকে আগুনে জ্বালাইব যা নিষেধ করা হয়েছে সে মহাপাপ থেকে যদি তোমরা ক্ষান্ত থাক, আমি তোমাদের ছোটখাটো দোষ সব ঢেকে দিব। ঘুষ নেয়া বাড়াবাড়ি ও অত্যাচার এবং এটা মহাপাপ। যেহেতু ঘুষ গ্রহণ করা হারাম সেহেতু এ হারাম উপার্জন ও ভক্ষণকারীর নেক আমলগুলো বরবাদ হয়ে যায়।
ঘুষ গ্রহণ করার অর্থ আল্লাহর অঙ্গীকারকে সামান্য পার্থিব বিনিময়ে নস্যাৎ করে দেওয়া যা সুস্পষ্ট হারাম ও নিষিদ্ধ। তা ছাড়া এ হারাম দ্বারা শরীরের যে অংশটুকু গঠিত হবে, তা জান্নাতে যেতে পারবে না এবং দোযখের আগুনে দগ্ধ হতে হবে। উল্লেখ্য, সরকারি বা বেসরকারি কর্মচারীগণ তাদের বেতন-ভাতা ব্যতিরেকে যেকোনো উপায়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় উৎকোচ হিসেবেই বিবেচিত হবে। তা ছাড়া যেসব কর্মকর্তা স্বজনপ্রীতি বা অর্থগ্রহণ করতঃ যোগ্য ব্যক্তিকে এড়িয়ে অন্যকে পদোন্নাতি বা চাকরি প্রদান করবেন, তারা আমানতের খিয়ানত করার কারণে আল্লাহর লা’নতের উপযুক্ত হবে এবং লা’নতকারীর ঠিকানা জাহান্নাম।
তাই জাহান্নামের শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমরা ঘুষ দিব না এবং ঘুষ খাব না এবং ঘুষের টাকায় পরিবার-পরিজনদের লালন করব না। আমরা এক আল্লাহকে বিশ্বাস করি, আল্লাহর অঙ্গীকারগুলো পরিপালন করি, পবিত্র কোরআন অনুসরণে জীবন ধারণ করি এবং মানুষকে সেবা প্রদান করি; তবেই আমাদের মুক্তি রয়েছে এবং জান্নাত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
মানুষ তার দেহ, রূপ, সন্তান, ধন-দৌলত সম্পত্তি, স্ত্রী, জ্ঞান, ইত্যাদি নিয়ে অহংকার করে থাকে। সামান্যতম কিছু ভালো জিনিস হলেই অহংকার করতে থাকি। আমরা পরিবার ও বংশ নিয়ে গরিমা এবং অহংকার করি। নিজকে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে পৃথক করা ও শ্রেষ্ঠ মনে করা, অন্যদেরকে নিজের তুলনায় ক্ষুদ্র ও অধম মনে করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে তার প্রতি অবাধ্য হওয়া ও আদেশ অমান্য করা এ সবই অহংকার প্রকাশের লক্ষণ ও তার আওতাভুক্ত।
অহংকারকে আল্লাহ অপছন্দ করেন এবং কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত করেন যদি না সে তওবা করে। সূরা বাকারাহ (আয়াত-৩৪) এ আল্লাহ বলেন, আমি ফেরেশতাদের বলেছিলাম আদমকে সিজদা কর। সবাই সিজদা করল। কেবল ইবলিশ ব্যতীত। সে অস্বীকার করল ও অহংকার করল। সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। এ আয়াতে এটাই প্রতীয়মান, আল্লাহর আদেশকে যে অহংকারবশত: অমান্য বা অবহেলা করে, আল্লাহর প্রতি তার ঈমান থাকলেও তাতে কোনো লাভ হবে না। সে ইবলিসের মতো, কাফের বলে গণ্য হবে।
নারীরা তাদের রূপ যৌবন নিয়ে অহংকার করে পোশাক পরিচ্ছদে নগ্নতা এনে অহংকার করে, ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে মিশে নিজেকে ধন্য মনে করে অহংকার করে, দেহদান করে অর্থ উপার্জন করে অহংকার করে এবং অন্য নারীদের তার সমকক্ষ মনে করে না। সে দুটি পাপ করল, একটি বেপরদা ও অপরটি অহংকার। অনেকে স্বামীকে নিয়ে এবং অনেকে স্ত্রীকে নিয়ে অহংকার করে, ধনসম্পদ নিয়ে অন্যদের সঙ্গে অহংকার করে, সন্তানদের সততা জ্ঞান ও বদমায়েসি (গুÐা/মস্তান) নিয়ে অহংকার করে এবং অন্যদের নিজের তুলনায় ক্ষুদ্র ও অধম মনে করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে।
অহংকারী লোকদের মনে শ্রেষ্ঠত্ব উদয় হয় এবং ঈমান হ্রাস পেয়ে পবিত্র কোরআনের হুকুম পালন করে না বা বিরত থাকে। এ অহংকারীগণ কিয়ামতের দিন ক্ষুদ্র কণার আকৃতিতে উঠানো হবে। লোকেরা তাদের পায়ের তলায় পিষ্ট করবে এবং চারদিক থেকে তাদের ওপর কেবল লাঞ্ছনা ও অপমান আসতে থাকবে। তাদের জাহান্নামের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে। তাদের মাথার উপরে আগুন জ্বলতে থাকবে এবং তাদের জাহান্নামবাসীর মলমূত্র, ঘাম, কাশি ইত্যাদি খেতে দিবে বলে সংগৃহীত তথ্য/হাদিস হতে জানা যায় (তিরমিজি)। সূরা আন-নাহলে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ অহংকারীদের অপছন্দন করেন’ এবং সূরা লুকমানে উল্লেখ আছে, ‘মানুষের প্রতি অহংকার বশে তুমি অবজ্ঞা করবে না এবং পৃথিবীতে ঔদ্ধতভাবে, অহংকারভাবে চলাফেরা করো না। আল্লাহ কোনো অহংকারী গর্বিত ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না।
যে ব্যক্তি অহংকারের সঙ্গে চলাফেরা করে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে সে যখন আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না এবং রাগান্বিত হবেন। সূরা হাদিদ (আয়াত-২০) আল্লাহ বলেন যে, ‘তোমরা সবাই জেনে রাখ যে, এ দুনিয়ার জিন্দেগানী শুধু খেলাধুলার মতো আমোদ, শোভা, পরস্পরের মধ্যে অহংকার করা এবং ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি বৃদ্ধি করার প্রতিযোগিতা; এটি বৃষ্টির মতো, যার উৎপন্ন দ্রব্য কৃষকদের খুশি করে, পরে সেটা শুষ্ক হয় এবং তুমিও সেটাকে হলদে বর্ণের দেখতে পাও, অবশেষে সেটা চ‚র্ণ-বিচ‚র্ণ হয়ে যায়।
কিন্তু যে ব্যক্তি আখেরাত ছেড়ে দুনিয়ায় মশগুল রয়েছে তার জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে আর নেককারদের জন্য তো আল্লাহর তরফ থেকে সন্তোষ ও ক্ষমা রয়েছে; আর এ দুনিয়ার জিন্দেগি (জীবন) তো শুধুই ছলনা মাত্র। যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আল্লাহ কোনো অহংকারী গর্বিত ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না।
সংগৃহীত তথ্যে জানা যায়, বলপ্রয়োগে ক্ষমতা দখলকারী জালিম শাসক, জাকাত আদায়ে অবহেলাকারী বিত্তশালী এবং অহংকারী ব্যক্তি জাহান্নামি হবে। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘যে অহংকার করে তাকে আমি আমার আয়াতসমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখব। অহংকার মানুষের হেদায়েতের পথ বন্ধ করে দেয়।’ হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার সাহাবীগণ, তাবে তাবেয়িনগণ, নবী-পয়গম্বরগণ, আল্লাহর ওলিগণ, আলেমগণ এবং যারা দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত তারা কেহই অহংকার করেনি।
যেহেতু আল্লাহ অহংকারীদের পছন্দ করেন না ও অভিসম্পাদ দেন সেহেতু আমাদেরও অহংকার থেকে দূরে থাকতে হবে। পার্থিব জগতের সবকিছুরই মালিক আল্লাহ এবং এ জীবন ক্ষণস্থায়ী, তাই অহংকার করে জাহান্নামে যাওয়া কোনোক্রমে কারো কাম্য নয়।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য