সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যুতে অস্থির হয়ে উঠেছে দেশ। প্রতিদিনই কোটা সংস্কার করার দাবিতে বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। সারাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি রোববার গভীর রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ হয়েছে। তাদের অন্যতত স্লোগান ছিল ‘চেয়েছিলাম অধিকার/ হয়ে গেলাম রাজাকার’, তুমি কে, আমি কে/ রাজাকার রাজাকার।’ আন্দোলন দমাতে সরকার চোখ রাঙানোর পাশাপাশি শক্তি ও আইন প্রয়োগের পথেও হাঁটছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশের। ওই ঘটনায় ১০ জন আহত হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উপর লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের গাড়ি ভাংচুর ও মারপিট করার মামলা করেছেন কনস্টেবল খলিলুর রহমান। কিন্তু তাতেও দমেনি শিক্ষার্থীরা। বরং মামলার পর বিক্ষোভের মাত্রা বেড়েছে।
শিক্ষার্থীদের দাবিকে কেউ যৌক্তিক বলছেন; আবার কেউ অযৌক্তিক বলছেন। হাইকোর্টের রায়ে পর বর্তমানে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ ভাগ কোটা রয়েছে। এটি কমিয়ে পাঁচ ভাগ করার দাবি করা হচ্ছে। তারা বলছেন, সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১০ শতাংশ কোটা থাকতে পারে। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী ও উপজাতীদের কথাও রয়েছে। এই দাবি অনেকের পছন্দ হচ্ছে না। তারা মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকারীদের জন্য ৩০ ভাগ কোটা রাখার পক্ষে নানা যুক্তি দিচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন বলছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটার দশভাগও পূরণ হয় না। তাহলে ৩০ ভাগ রেখে লাভ কী? আসলে অনগ্রসর মানুষদের মূলধারায় যুক্ত করতে সরকারি চাকরিতে কোটা রাখা হয়। এখানে রাগ, ক্ষোভ কিংবা অভিমানের সুযোগ নেই। একটা যৌক্তিক সমাধান দরকার। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে ৫৬ শতাংশ কোটা হয় কি করে? হয়তো কোনটা একটা সময় ও পরিস্থিতিতে সেটা ঠিক ছিল। তা-ই বলে সেটা সংশোধন করা যাবে না- বিষয়টি এমন নয়। ভুলে গেলে চলবে না- জনদাবির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোও সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কোটা আন্দোলনের সমালোচনা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এই আন্দোলন ও আন্দোলনকারীদের বক্তব্য সংবিধান বিরোধী’। এখানে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮ এর দফা ৪ এবং অনুচ্ছেদ ২৯ এর দফা ৩ দফা উল্লেখ করা যায়। সেখানে অনগ্রসরদের জন্য প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা আছে।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যারা চাকরি পাচ্ছেন তারা সবাই ওই ধারায় পড়েন না। অনেক এগিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকারী কোটায় চাকরি পেয়েছেন। সংবিধানের ওই ধারা মেনে কেবলমাত্র অনগ্রসর মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য কোটা রাখা যৌক্তিক বলে মনে করি। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো- মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার করার অর্থ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাকে অসম্মান করা নয়। আরেকটা কথা ভুলে গেলে চলবে না- মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধীকারও মেধাবী। কোটা কমলেও তারা যে সরকারি চাকরি পাবেন না- এমনটা বলা যাবে না। আসলে মেধা পরিমাপের তো কোনো যন্ত্র নেই। তা-ই কে মেধাবী, কে নন তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তবে প্রচলিত পদ্ধতিতে পরীক্ষায় যারা প্রথমদিকের ফল করেন তাদেরকে মেধাবী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ফলাফলে সব চেয়ে এগিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা সাধারণত পাবলিক সার্ভিসে আসেন না। তারা সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক হিসেবে কাজ করেন। অনেকে পাড়ি জমান বিদেশে।
পাবলিক সার্ভিসে আসা শিক্ষার্থীদের রেজালন্ট তাদের চেয়ে সামান্য নীচে। মুক্তিযোদ্ধারা যে ভাতা পাচ্ছেন ও রাষ্ট্রীয় নানা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তা নিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন তোলেনি। আন্দোলনকারীরাও মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাদ দিতে বলেননি। তারা চাচ্ছেন সংস্কার। এ নিয়ে কথা বললেই তাকে ‘মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী’ বলা যাবে না। আবার মুক্তিযোদ্ধা সনদের অপব্যবারও হচ্ছে। দিনদিন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ছে। এরই মধ্যে অনেকের সনদ বাতিল করা হয়েছে। আবার বগুড়ায় রফিকুল ইসলাম নামে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা অর্থের বিনিময়ে সাত ভুয়া সন্তানকে সরকারি চাকরি দিয়েছেন। অভিযোগের শেষ এখানেই নয়। রাজাকার থেকেও অনেকে হয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধা’। এমনটাই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক সালেক খোকনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার গোসাইবাড়ি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হবার পর যেসব রাজাকার তার নিকট আত্মসমর্পণ করেছিল; তারা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ জোগাড় করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে।’ এটা অবশ্যই লজ্জার। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনা; মুক্তিযোদ্ধারা সূর্য সন্তান। তাদের প্রতি স্যালুট। কোটার ফ্রেমে ফেলে তাদের ‘ছোট’ করা হচ্ছে কি না, তা-ও ভেবে দেখা এখন সময়ের দাবি। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য