-->
শিরোনাম

জামায়াতকে জোটে চায় না বিএনপির তৃণমূল

এম. সাইফুল ইসলাম
জামায়াতকে জোটে চায় না বিএনপির তৃণমূল

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের সাজার পর জামায়াতে ইসলামীকে জোটে রাখা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ২০-দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তাই আগামী সংসদ নির্বাচনে তারা জামায়াতকে জোটে দেখতে চান না।

তারা বলছেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আর দলটির নেতাদের যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় কার্যকরের পর জ্বালা-পোড়াও আন্দোলন করে জামায়াত এখন ইমেজ সংকটে। জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে দিলে বিএনপির ইমেজ বৃদ্ধি পাবে বলেও মনে করছে তৃণমূল।

তবে তৃণমূলের বক্তব্যকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে বিএনপির নেতারা বলছেন, আদর্শিক মিল না থাকলেও ভোটের রাজনীতিতে জোট চলে। আর জোটে ভাঙনের কোনো আশঙ্কা দেখছেন না জামায়াত নেতারা।

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে জোটে অন্তর্ভুক্ত হয় জামায়াত ইসলামী। ওই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে জোটটি। গুরুত্বপূর্ণ দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয় বিএনপি-জামায়াত জোটের।

২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী, ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার।

এরই মধ্যে জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নয় নেতার বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে।

আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। কারাগারে সাজা ভোগ করা অবস্থায় মারা গেছেন দলটির সাবেক আমীর গোলাম আযম, এ কে এম ইউসুফ ও নায়েবে আমির আবদুস সুবহান। এখন আপিল বিভাগে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম।

২০১৩ সালের আগস্টে দেশের সর্বোচ্চ আদালত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে রায় দেয়। এ রায়ের পর থেকে জামায়াত তাদের নিজস্ব প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ মার্কা নিয়ে ভোট করার ক্ষমতাও হারিয়েছে। সব মিলিয়ে জামায়াত এখন ইমেজ সংকটে পড়েছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে নতুন প্রজন্ম জামায়াতকে ভালোভাবে গ্রহণ করছে না।

গত সংসদ নির্বাচনেও জামায়াত ২০-দলীয় জোটে ছিল। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করায় খুব একটা গুরুত্ব পায়নি দলটি। এখন আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনমুখী প্রচারে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা হিসেব-নিকেশ।

নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতের সঙ্গে জোটটির নেতৃত্ব থাকা বিএনপির সম্পর্ক কেমন চলছে তা জানতে অনুসন্ধান চালায় দৈনিক ভোরের আকাশ। কথা হয় বিএনপির মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে। রাজধানী ঢাকার মিরপুর, শাহবাগ, রমনা ও রামপুরা থানার নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের অভিমত।

তারা বলছেন, জামায়াতকে এখন আর মানুষ বিএনপি জোটে দেখতে চায় না। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াত এখন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেও জামায়াতকে নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে। তাছাড়া ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করায় দেশের সচেতন মানুষ ক্রমেই জামায়াতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

রাজধানীর বাইরেও বিএনপির তৃনমূলে জামায়াতবিরোধী ‘সেন্টিমেন্ট’ তৈরি হয়েছে বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। কেন্দ্রীয় নেতারা কৌশলগত কারণে জামায়াতবিরোধী বক্তব্য দেন না, তাই প্রকাশ্য বিএনপির কর্মীরা জামায়াতের বিরুদ্ধে সরাসরি মুখ খুলতে চান না।

কয়েকজন বিএনপি কর্মী জানান, জামায়াত দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন দেখেছে দেশের মানুষ। জোটটির শরিক জামায়াত ধ্বংসাত্মক রাজনীতি করলেও তার দায় এড়াতে পারেনি বিএনপি।

জামায়াতকে জোটে রাখায় বিএনপির অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব জোটটি নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছেন। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে কিছুদিন আগেও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে বিএনপি থেকে জামায়াতকে বের করে দেওয়ার জন্যে খালেদা জিয়ার প্রতি অনুরোধ জানান।

জামায়াতের কারণে বিএনপি কলঙ্কিত হচ্ছে বলেও ডা. জাফরুল্লাহর দাবি। এছাড়া গত ৩০ অক্টোম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ ও শামসুজ্জামান দুদু সরাসরি জামায়াতের বিরুদ্ধে কথা বলেন।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সঙ্গে।

তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘জামায়াত তার নিজস্ব রাজনীতি করে। বিএনপি চলে তার নিজস্ব সত্তায়। ভোটের ক্ষেত্রে জোটের রাজনীতি নতুন কোনো কথা নয়।

‘জামায়াতের সঙ্গে কোনো আদর্শিক মিল নেই বিএনপির। তাই জামায়াতের কোনো দায় বিএনপি নেবে না। তবে আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ জোট ভাঙতে নানা ফাঁদ ফেলার চেষ্টা করছে। সরকার চেষ্টা করলেও জোট ভাঙার কোনো আশঙ্কা নেই।’

দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানান, জামায়াতকে নিয়ে বিএনপিতে কোনো অস্বস্তি আছে বলে তার জানা নেই।

এ ব্যাপারে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির তৃণমূলে কোনো অসন্তোষ নেই। ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে যদি কেউ বাড়িয়ে কিছু বলেন তবে কিছু করার থাকে না।’ক বুদ্ধিজীবী আছেন যারা জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট নিয়ে একটু বেশি বলে থাকেন। তাদের বুঝতে হবে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো আদর্শিক মিল নেই। দলটির সঙ্গে শুধু জোট করা হয়েছে।’

কথা হয় জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা সদস্য মাওলানা আজিজুর রহমানের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘বিএনপির তৃণমূলের এ অভিযোগ সঠিক নয়। দেশের বেশির ভাগ স্থানে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সুসম্পর্ক। যে যাই বলুক না কেন, জোট প্রধান খালেদা জিয়া জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেওয়ার চিন্তা কখনো করেন না বলেও দাবি তার।’

এ ব্যাপারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘২০-দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক অটুট আছে। একটি পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে যেমন সব সময় সুস্পর্ক থাকে না তেমনি জোটের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে দু-একটি জায়গায় ঝামেলা থাকতে পারে।’

মন্তব্য

Beta version