সদ্য সমাপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন ছিল বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিজয় অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ।
স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হলেও নির্বাচনে দলের নেতাকর্মীরা তাকে চূড়ান্তভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন। সেইসঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সরাসরি নির্বাচন পরিচালনা করতে দেখা গেছে।
মিছিল-মিটিংয়ে সব সময় বিএনপি তথা ২০ দলের নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি ছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিজয় ধরে রাখতে আওয়ামী লীগও সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করতে দেখা গেছে এ নির্বাচনে।
দলের প্রার্থী আইভীর সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের প্রকাশ্য বিরোধ নিরসনে কাজ করেছেন খোদ কেন্দ্রীয় নেতারা। কেন্দ্র থেকে নির্বাচন দেখভালের জন্য পৃথক কমিটি রাতদিন কাজ করেছে। দলপ্রধান হিসেবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও নির্বাচনের খোঁজখবর রেখেছেন।
সব মিলিয়ে প্রকৃতঅর্থে বড় দুই রাজনৈতিক দলই নাসিক নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের ঘরে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে।
জয়-পরাজয়ের হিসাবের খাতা মিলালে দেখা যায়, ব্যক্তিগত ইমেজ-দলের সমর্থন মিলিয়ে হ্যাট্রিক বিজয় হয়েছে আইভীর। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতির হিসাব বলছে, তৈমূরের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় এত ভোট পাওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে দল ও জোটের সমর্থিত ভোটগুলোই বলছে কৌশলে বিএনপিরও লক্ষ্য ছিল নির্বাচনে বিজয় অর্জন করা।
গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের ভোটে নৌকা প্রতীকে আইভী ৬৬ হাজার ৯৩১ বেশি ভোটে মেয়র হিসেবে টানা তৃতীয়বার জয় পান।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯২টি কেন্দ্রে আইভীর প্রাপ্ত ভোট ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী হাতি মার্কার তৈমূর আলম খন্দকার পেয়েছেন ৯২ হাজার ১৬৬ ভোট। নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৬১।
এবারের নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন খুবই ষড়যন্ত্রমূলক ছিল বলে মন্তব্য করেছেন তৃতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হওয়া আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি বলেছেন, চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের মধ্যে কাজ করতে হয়েছে তাকে।
শনিবার ‘জনপ্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং অভিজ্ঞতা শীর্ষক’ এক ভার্চুয়াল সংলাপে আইভী জানান, ষড়যন্ত্রে পড়লেও জনগণের আস্থা আর ভালোবাসার কারণে সেখান থেকে বের হতে পেরেছেন তিনি।
আইভী বলেন, ‘এবারের নির্বাচন কঠিন ছিল। তিনটি মেয়র নির্বাচন করেছি। তিন নির্বাচনের ফ্লেভার তিন রকম ছিল। কোনো নির্বাচনেই ষড়যন্ত্রের বাইরে ছিলাম না।
‘সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নির্বাচন করেছি। যদিও আমার দল আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল, কিন্তু প্রতিবারই বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়ে সাধারণ জনগণকে আস্থায় এনে নির্বাচনে জিততে হয়েছে।’
নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গটি ইঙ্গিত করে আইভী জানান, তার কোনো বাহিনী নেই। অনেক বাধা এসেছে, এমনকি তাকে হত্যার প্রচেষ্টাও করা হয়েছে। এরপরও কখনোই বাহিনী তৈরি করেননি।
নাসিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের অবসানও চেয়েছে ক্ষমতাসীন দল। নির্বাচন শেষে বিএনপির নেতা হিসাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূরও কোনো কারচুপির অভিযোগ আনতে পারেননি।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরাও বলেছেন, নাসিক নির্বাচন ছিল সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে নিরপেক্ষতার দিক থেকে সবচেয়ে মডেল নির্বাচন।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও বলছেন, এরকম মডেল নির্বাচনের ধারাবাকিতা ধরে রাখতে চান তারা।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে যে নির্বাচন হয়েছে, ইনশাআল্লাহ আগামী (২০২৩ সালে) জাতীয় সংসদ নির্বাচনও এরকম সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়। এমন সুন্দর নির্বাচন হয়েছে, প্রচারণা থেকে নির্বাচন পর্যন্ত কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয়নি।
মন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচন থেকে পালিয়ে গেলেও তারা ভিন্ন অবয়বে সব নির্বাচনেই অংশ নিয়েছে। সুতরাং তারা জানে, তাদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা এখন কোথায়।’
সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। যার ধারাবাহিকতায় সাত দফা ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি দলটি। তবে দলের সমর্থিত প্রার্থীদের অনেকে স্বতন্ত্র থেকে বিজয়ী হয়েছেন।
নাসিক নির্বাচনেও প্রার্থী দিতে নারাজ ছিল বিএনপি। শেষ পর্যন্ত তৈমূরের স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণায় জেলা কমিটিসহ চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার পদ থেকে আগেই তাকে বাদ দেওয়া হয়।
নির্বাচনের পর দল থেকেই বহিষ্কার করা হয়েছে তাকে। একইসঙ্গে বহিষ্কার করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামালকেও।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা কৌশলে নাসিক নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি তা সঠিক নয়। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমরা অংশ নেব না। কেউ যদি শৃঙ্খলা ভাঙে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এটাই স্বাভাবিক।’
যদি তৈমূর পাশ করত তাহলে কি বহিষ্কার করা হতো? এমন প্রশ্নে তারা বলেন, পাস করলে দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হতো।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এমন কথায় পশু-পাখিরাই বিব্রতবোধ করে। আপনারা কেন বিব্রতবোধ করেন না।
‘আন্দোলনের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি ফেলে দেওয়া হবে। তখন ভোটাররা যার যার ভোট ব্যালট পেপারে দেবেন। যাকে খুশি তাকে দেবেন। সুষ্ঠু নির্বাচনে হেরে গেলেও সম্মান রয়েছে। ভোট চুরিতে সেটি তো নেই।’
মন্তব্য