সাত ধাপে শেষ হওয়া দশম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে বেকায়দায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে এসব প্রার্থীর স্থানীয়ভাবে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। স্থায়ী বহিষ্কারের জন্য বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো হয়েছে। দলীয় পদ ঠিক রাখতে ভোট শেষে এখন বিদ্রোহী প্রার্থীরা ঢাকায় এসে কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসা ও দলীয় অফিসে ধরনা দিচ্ছেন। প্রভাবশালী লোকদের দিয়ে বিভাগীয় সাংগঠনিক নেতাদের ফোন করাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত তাদের ভাগ্যে কী আছে তা এখনো নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। সবকিছু নির্ভর করছে দলপ্রধান শেখ হাসিনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ওপর।
এদিকে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আওয়ামী লীগ। তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রাথমিক নির্দেশনা দিয়েছেন দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনেকেই বলছেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থীদের বিপরীতে নির্বাচন করা দলের বিদ্রোহীদের বিষয়ে এবার আর কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহীদের ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত কিছুটা হলেও নমনীয় হতে পারে ক্ষমতাসীন দল। তবে তাদের দলে রাখলেও কমিটির কোনো পদ দেওয়া হবে না। সাধারণ সদস্য পদ নিয়েই তাদের কাজ করে যেতে হবে। এমনও হতে পারে ভবিষ্যতে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করবে না এমন মুচলেখা দেওয়ার পরই তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হতে পারে।
বিদ্রোহীদের ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্তের বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতার দ্বিমত রয়েছে। তারা বলছেন, ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সাত ধাপে দেশে ৪ হাজার ১১১টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে তিন থেকে সর্বোচ্চ পাঁচজন পর্যন্ত দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল। সব মিলিয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়া ও তাদের পক্ষে মাঠে থাকা, মদদ দেওয়াসহ শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় ইতোমধ্যে সারা দেশে আওয়ামী লীগের ১০ সস্রাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের চূড়ান্তভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হলে আগামী নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব পরতে পারে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আওয়ামী লীগ। কারণ আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের মধ্যে অনেকের স্থানীয়ভাবে বেশ জনমত রয়েছে। আবার বিদ্রোহীদের মধ্যে যারা পাস করতে পারনেনি তাদেরও কমবেশি জনমত থাকা স্বাভাবিক। তাদের দল থেকে চ‚ড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হলে নির্বাচনে এসব লোকজন অন্যদলের হয়ে কাজ করতে পারে।
দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, ইউপি নির্বাচনে মনোনয়নে বেশ ভুল ত্রæটি ছিল। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এসেছে। ভুলের কারণে অনেক জায়গায় বিদ্রোহী প্রার্থী বেড়েছে। সহিংস ঘটনা বেশি ঘটতে দেখিছি। তাছাড়া যেহেতু বিএনপি স্থানীয় সরকার বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল সেক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক বাদ নিয়ে নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিলে খুব একটা ক্ষতি হতো না। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে নিজেদের মতামত তুলে ধরেছেন কয়েকজন নেতা।
এদিকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ দলীয় কোনো পদে আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। এছাড়া যাদের শোকজ করা হয়েছে তাদের জবাব সন্তোষজনক না হলে একই নিয়ম কার্যকর হবে বলেও সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
খুলনা বিভাগের সাংগঠনিক জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকবৃন্দ, দলীয় সংসদ সদস্যগণ এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের গত বুধবার ভার্চুয়াল বৈঠকে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা খুলনা বিভাগের নেতাদের উদ্দেশে বলেন,‘ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সভায় দলেরনেত্রী শেখ হাসিনা) কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সে দিকনির্দেশনার আলোকে আমাদের আজকের এ সভা। এ সভার লক্ষ্য হচ্ছে, তৃণমূল পর্যায়ে নেত্রীর যে নির্দেশনা ছিল সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া।
এগুলো হলো, মেয়াদোত্তীর্ণ শাখায় সম্মেলন করা, সংগঠনকে নতুন করে ঢেলে সাজানো। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে দলের সাংগঠনিক অনেক কাজ করা সম্ভব হয়নি। আগামী ২১ ফেব্রæয়ারির পর সাংগঠনিক কার্যক্রমকে গতিশীল করা।
যারা দলের নির্দেশনা মানে না, তাদের বিষয়ে আগে থেকেই দলের নির্দেশনা আছে জানিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, যারা বহিষ্কার হয়েছে, সাময়িক বহিষ্কার হয়েছে, শোকজ হয়েছে, তাদের বিষয়টা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দলের কোনো কমিটিতে নেতৃত্বে আনা যাবে না। তবে যাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে তাদের জায়গা দেওয়ার সুযোগ আছে। এছাড়া দলকে গণমুখী করা ও আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে ঢেলে সাজাতে হবে। যাতে দলের নতুন নেতৃত্বের ওপর জনগণের প্রত্যাশার জায়গাটা আরো শক্তিশালী ও সুদৃঢ করা যায়। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে দলের সম্মেলনগুলো সম্পন্ন করতে হবে।
চলমান ইউপি নির্বাচনে ইতিমধ্যে সাত ধাপের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। গত ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম ধাপের দুই দফায় ৩৬৯টি এবং ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৩টি, গত ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপে ১ হাজার ইউপিতে এবং চতুর্থ ধাপে ২৬ ডিসেম্বর ৮৩৬ ইউপিতে ভোট গ্রহণ হয়।
এছাড়া ৫ম ধাপে গত ৫ জানুয়ারি ৭০৮ ইউপিতে, ৬ষ্ঠ ধাপে গত ৩১ জানুয়ারি ২১৮ ইউপিতে, গত ৭ ফেব্রæয়ারি সপ্তম ধাপে ১৩৮ ইউপিতে এবং গত ১০ ফেব্রয়ারি স্থগিত হওয়া কয়েকটি ইউপিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে দেশে ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। সব মিলিয়ে দেড় হাজারের বেশি ইউনিয়নে এবার দলীয় প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরেছে বলে জানা গেছে।
এবারের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় প্রাণ গেছে অন্তত ১৪০ জনের। ২০১৬ সালের তুলনায় এবার ১২ ভাগ ইউপি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ৫২ ভাগ ইউপিতে পাস করেছে নৌকার প্রার্থীরা। বিনা ভোটে পাসের হার নয় ভাগ, বিদ্রোহী ২২ ভাগ, বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিএনপি সমর্থিদের পাসের হার আট ভাগ, বাদবাকি অন্যান্য দল থেকে পাস করেছে।
দলটির সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলছেন নির্বাচন নিয়ে তারা আলোচনা করে দলীয় পদক্ষেপ নেবেন। তবে আশা করি দলের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করেই হয়ত ইউপি নির্বাচনে দলের বিদ্রোহীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত করবেন।
তবে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলছেন স্থানীয় নির্বাচনে এলাকার ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দুটি সমস্যা হয়েছে - তাহলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অর্থাৎ বিএনপি জামাত সরাসরি অংশ না নিয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নিয়েছে। আবার ভোটারেরা যেন একাধিক প্রার্থী পায় সেজন্য দলের নেতাদের অনেক জায়গায় মেনে নিতে হয়েছে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে দল প্রধানের নির্দেশনার ওপর।
মন্তব্য