-->
নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা

বাড়ছে বিরোধী জোটের চাপ

* নির্দলীর সরকার চায় বিএনপি * জাতীয় সরকারের পক্ষে অন্যরা * সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন চায় আওয়ামী লীগ

রাজন ভট্টাচার্য
বাড়ছে বিরোধী জোটের চাপ
জাতীয় সংসদ। ফাইল ছবি

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কেমন হবে এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়োগের বিতর্ক থেকে সরে এসে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করছে। ভিন্নমত রয়েছে বিএনপির মিত্র দলগুলোর। জেএসডি, এলডিপি, নাগরিক ঐক্যসহ অন্য দলের বক্তব্য জাতীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হওয়া উচিত। আর বিরোধী দল জাতীয় পার্টি চায় সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন। সব মিলিয়ে সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের নতুন রূপরেখার চাপ বাড়ছে।

এদিকে বিরোধী দলগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলছে, যতই চাপ আসুক নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন নয়। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সর্বশেষ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখায়। সংবিধানের বাইরে এক চুলও সরতে নারাজ টানা তিনবারে মেয়াদে থাকা আওয়ামী লীগ। চলমান এই রাজনৈতিক সংকট সমাধানে বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা নয় একথাও সাফ জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। তবে আলোচনায় না বসলেও বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে আরো প্রায় দুই বছর বাকি। ২০২৩ সালের শেষের দিকে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। দীর্ঘ সময় বাকি থাকলেও কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে বিরোধী দলগুলোর এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে রাজপথে সরব হয়েছে। বিভিন্ন সভা সমাবেশসহ বিবৃতিতে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা তুলে ধরছেন তারা।

২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার শরিক জোটগুলো এর পর থেকেই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা পুনরায় চালু করার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। তখনই বিরোধীদলীয় প্রধান খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না বলে ঘোষণা দেন। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তরর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমেই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যোগ করা হয়েছিল। তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে নির্বাচন নিরপেক্ষ করার যুক্তি দেখিয়ে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছিল।

এ ব্যাপারে ১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলেছিলেন। যেখানে বিএনপিকে স্বরাষ্ট্রসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাবও ছিল। বিএনপি তাতে সাড়া দেয়নি। বর্তমানে বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি তুললেও কোনো রূপরেখা দেয়নি। সংবিধানের মধ্যে থেকে বিএনপি যদি নির্বাচনকালীন সরকারের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়, সেটা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি জানিয়ে বলেছেন, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও মিত্রদের মধ্যে যারা জাতীয় সরকারের কথা বলছেন সেই দাবিকে আলাদা করে দেখছেন না তারা। কেউ যদি জাতীয় সরকারের কথা বলে থাকে, এটা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন। এটি নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি হবে না।

একাধিক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তিনি বলেন, আমাদের দলের দাবি- কোনো দলীয় সরকার নয়, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, নির্দলীয় সরকার অল্প সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক ক্যাডারদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ থেকে সরাতে পারবে না। রাজনৈতিক নিয়োগ কর্মকর্তাদের হাত থেকে প্রশাসনকে মুক্ত না করা পর্যন্ত দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সর্বোপরি জনগণের সরকারও প্রতিষ্ঠা হবে না। তাই জাতীয় সরকার দরকার।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, জাতীয় সরকার বললে একটি চরিত্র দাঁড়ায়। যাতে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের অংশগ্রহণ থাকবে। এত আন্দোলন-সংগ্রাম করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবার তাদের নিয়েই জাতীয় সরকার হলে বিষয়টি কেমন হবে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, আমরা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন চাই। কোন দল কী বললো এসব নিয়ে ভাবনা নেই। আমরা সব সময় নির্বাচনমুখী রাজনীতি করি, যেন দেশে পরিচালনায় কখনো সাংবিধানিক সংকট তৈরি না হয়।

গত ২ মার্চ স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন দিবসের ৫১ বছর উদযাপন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে জেএসডি সভাতি আ স ম রব। বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে আর নির্বাচন নয়। গণআন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তির সমন্বয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গড়ে তুলতে হবে। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এখনো নির্দলীয় সরকার চান।

সম্প্রতি গণফোরামের কর্মসূচিতেও তিনি বলেছেন, আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নেওয়ার দাবি জানাই। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য হয় না।

আওয়ামী লীগ বলছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতোই সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। জানতে চাইলে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল অব. ফারুক খান বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সুযোগ নেই। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতোই সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অধীনে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় তো আওয়ামী লীগ সরকারে থাকবে না। থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের দুটি দায়িত্ব থাকবে।

তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসা। সে লক্ষ্যে দল গোছানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

মন্তব্য

Beta version