দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হবে-দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার এমন ঘোষণার পরই রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। চলছে নানামুখি আলোচনা। শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তৎপরতাও।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ১৪ দলের শরিকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মনোভাব খুবই ইতিবাচক। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নির্বাচন উপহার দিতে হলে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করেন নেতারা। তবে আওয়ামী লীগ বলছে, কোনো অবস্থাতেই সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন সম্ভব নয়। সংবিধানের মধ্যে থেকে বিএনপির দাবি দাওয়া পূরণে কিছুটা ছাড় দেওয়া হতে পারে। কোনো কোনো নেতা বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রয়োজনে আলোচনারও আভাস দিয়েছেন।
২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রয়েছে সমালোচনা। যদিও এবারের সংসদেও বিএনপির প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। বিএনপি বরাবরই বলে আসছে কারচুপির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বারবার ক্ষমতায় আসছে আওয়ামী লীগ। রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান তৈরি ও সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তার জন্য বিশে^র প্রভাবশালী দেশগুলোর দ্বারস্থ হয়েছে বিএনপি। এর প্রেক্ষিত্রে আওয়ামী লীগও কিছুটা চাপের মুখে।
সর্বশেষ ক্ষমতাসীন দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে শেখ হাসিনা নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অংশগ্রহণ ইস্যুতে ইতিবাচক যে মনোভাব দেখিয়েছেন তা আন্তর্জাতিক চাপের কারণে হতে পারে বলেও মনে করেন অনেকেই। কারণ যাই হোক, বিএনপিও অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে নির্বাচন করতে চায়। আবার বদনাম ঘাড় থেকে ফেলতে চায় আওয়ামী লীগ। উভয় পক্ষের প্রয়োজনের তাগিদেই আগামীতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা সব দলের নেতাদের।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, গত ৭ মে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে দলের এক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না, এটি উত্থাপন করেন। তখন নেত্রী সাফ বলে দিয়েছেন, আমরা সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেশবাসীকে উপহার দেব। সেক্ষেত্রে যা যা করা দরকার সেটি করা হবে।
তখন ওই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জানতে চান, আমরা কী কী করলে তারা নির্বাচনে আসবে। এর উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, সেটি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আপনাদের সবাইকে আরো কৌশলী হতে হবে, যাতে বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে অংশ নেয়।
কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, বিএনপি নির্বাচনে এলে তাদের স্বাগত জানাব। তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো পালন করবে। সেক্ষেত্রে তাদের কোনো বাধা দেওয়া হবে না। তারা নির্বাচনি কর্মসূচি পালন করতে পারবে। দেশের জনগণের কাছে যাবে। গণসংযোগ করবে এটাই স্বাভাবিক।
দলীয় সূত্র বলছে, গত ৭ মে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে কীভাবে আনা যায় এ বিষয়ে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনা চান উপস্থিত নেতারা। পরে শেখ হাসিনা নেতাদের বলেন, যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে ভয় পায় তারাই চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক, যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া যায়। তবে আমি চাই সবার অংশগ্রহণ।
তিনি বলেন, তাদের কীভাবে নির্বাচনে আনতে হবে, সময় বুঝে ব্যবস্থা নেব। নির্বাচন হবে ইভিএম পদ্ধতিতে। এ নির্বাচনে আমরা সব দলের অংশগ্রহণ চাই। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটে যাকেই নৌকা দেওয়া হবে তাকে নিজের দক্ষতায় জিতে আসতে হবে। প্রতিটি নির্বাচনি আসন ধরে জরিপ চলছে। জরিপের আলোকে প্রার্থী বাছাই করা হবে। যাকে দিয়ে বিজয়ী হওয়া সম্ভব তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। এজন্য আপনাদের এলাকায় যোগাযোগ বাড়াতে হবে। কর্মীবান্ধব হতে হবে। সবাইকে নিয়েই কাজ করতে হবে।
দলপ্রধানের এমন বক্তব্যের পর রোববার সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই নির্বাচনে আসতে হবে। আমরাও একটি শক্তিশালী বিরোধী দলকে সংসদে স্বাগত জানাতে চাই। চাইব বিরোধী দলের স্ট্যান্ড থাকুক। আমরা বিএনপিকে বলব তাদের নির্বাচনে আসতে।
তিনি বলেন, নির্বাচনে আসা তাদের অধিকার, এটা সুযোগের ব্যাপার নয়। বিএনপি অধিকার প্রয়োগ না করলে তাদের অস্তিত্ব সংকট হবে। সে ধরনের পরিস্থিতি তারা তৈরি করবে না, এটা আমার বিশ্বাস।
কাদের বলেন, দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সব দল নির্বাচনে আসুক। বিএনপিসহ সব দলকে নিয়েই ভোট করতে চাই। নিশ্চয়তা দিচ্ছি নির্বাচন ফেয়ার হবে। ইভিএমে ভোট হবে, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকবে। তাদের লোকও সংসদে আছেন। স্পিকার তাদের কথা বলার সুযোগ দেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সংবিধানের ভেতরে থেকেই প্রয়োজনীয় ছাড় দেওয়া হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যা কিছু করার প্রয়োজন, তার সবকিছুই করা হবে। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়া হবে নির্বাচন কমিশনকে। প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার সুযোগ নিতে হবে। তবে বিএনপির নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি মানার সুযোগ নেই। এটা সংবিধানবিরোধী।
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে কৌশল নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান। তিনি বলেছেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সংবিধানের ভেতরে থেকেই ছাড় দেওয়া হবে। আর সময়ই বলে দেবে, কখন কী করতে হবে। কৌশলও নির্ধারণ করা হবে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। রাজনীতিতে দর-কষাকষি থাকবেই। তবে একটা পর্যায়ে সমঝোতা হবে। বিএনপিও নির্বাচনে আসবে।
১৪ দলের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার উদ্যোগ গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক ঘটনা। আর বিএনপিরও এটাতে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াই জানানো উচিত, যদি সত্যিকারার্থেই তারা দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দেখতে চায়।
১৪ দলের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ও আন্তরিকতাকে স্বাগত ও ধন্যবাদ জানাই। আশা করি, প্রধানমন্ত্রীর এই আন্তরিকতার প্রতি সাড়া দিয়ে বিএনপিসহ সব দল আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এরপরও কোনো দল নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, সেটা অন্য রাজনৈতিক দলের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে না।
গণতন্ত্রী পার্টির সহসভাপতি নূরুর রহমান সেলিম বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের আয়োজনের খবর দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে ইতিবাচক বার্তা। এই কাজটি যদি শেষ পর্যন্ত করা সম্ভব হয় তাহলে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক কমবে। এর আগে অবশ্যই নির্বাচনের পরিবেশ সবার জন্য সমান তা যেন নিশ্চিত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
গণফোরাম একাংশের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল দল নির্বাচনে অংশ নেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিগত দুই নির্বাচন ধরে অনেক দল নির্বাচনে আসতে নারাজ। সমঝোতার মধ্য দিয়ে যদি রাজনীতির বরফ গলে এটা সবচেয়ে ভালো।
যদিও বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গেলে প্রতারণার ফাঁদে পড়তে হবে। আওয়ামী লীগের নেতারা যা বলছে-তা মিথ্যা, প্রতারণার কথা বলছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে জনগণ যাকে ভোট দেবে তারাই ক্ষমতায় আসবে।
মন্তব্য