-->
শিরোনাম
রাজনীতির মাঠে উত্তাপ

নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে থাকবে আ.লীগ

রাজন ভট্টাচার্য
নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে থাকবে আ.লীগ

ঢাকা: দলের পক্ষ থেকে সংঘাতে না জড়ানোর নির্দেশ দিলেও আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত মাঠ ছাড়ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের রাজনৈতিক মিত্রগুলোর সমন্বয়ে চলমান এবং সামনের দিনগুলোয় যুগপৎ আন্দোলনের নামে দেশব্যাপী নৈরাজ্য ঠেকাতেই সতর্কাবস্থায় মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি মাসেই ঢাকাসহ সারা দেশে ১৪ দলের পক্ষ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা। বিভাগীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হবে সমাবেশ। মাঠে নামবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও। দলের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সব মিলিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে মাঠের রাজনীতি। অথচ নির্বাচনের এখনো ১৫ মাস বাকি। দেশের বৃহত্তম দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে রাজপথের মিছিল-সমাবেশ নিয়ে প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পুলিশের গুলি ও হামলাকারীদের আঘাতে বিএনপির চার কর্মীর মৃত্যু হয়েছে।

এ অবস্থায় আবার দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের পারস্পরিক হুমকি-ধমকিসহ উসকানিমূলক বক্তব্য নাগরিক সমাজে উদ্বেগ ও শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতিতে বিশিষ্টজনরা রাজনৈতিক শক্তির প্রতি গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার আহ্বান জানিয়েছেন। মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে মাঠে নামে বিএনপিসহ তাদের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো।

এর সঙ্গে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ আরো বেশকিছু বিষয় রয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে সংবিধানের মধ্যেই নির্বাচন। অর্থাৎ নির্বাচন হবে রাজনৈতিক সরকারের অধীন। তবে নির্বাচনের সবরকমের কর্তৃত্ব থাকবে নির্বাচন কমিশনের হাতে।

এ সময়ে সরকার রুটিন কাজ পরিচালনা করবে। কিন্তু সংবিধানিক নিয়ম মেনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে না বিরোধী দলগুলো। তাই নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। এসব কর্মসূচিকে ঘিরেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনীতি। ঢাকা, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, নেত্রকোনা, বারহাট্টাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় বিএনপির কর্মসূচিকে ঘিরে পুলিশসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। আর প্রতিটি ঘংঘর্ষে হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে বিএনপি নতুন নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করছে।

সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা অচিরেই ঘোষণা করা হবে। ইতোমধ্যে অন্তত ১০টি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। এ প্রেক্ষাপটে সামনের দিনগুলোয় রাজনীতির মাঠ আরো বেশি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রাজনৈতিক দল ও সচেতন মহলের।

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আন্দোলনের বিকল্প কিছু দেখছে না তারা। এর কারণ হিসেবে দলটির নেতারা বলছেন, দলের পক্ষ থেকে বারবার দাবি জানানো হলেও সরকার তা কোনোভাবেই আমলে নিচ্ছে না। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইস্যুতে ২৯ জুলাই থেকে বিএনপি সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলে এবং আওয়ামী লীগের তরফে বাধা দেয়ায় সংঘাত-সহিংসতা শুরু হয়। ঘোষণা দিয়ে ২২ আগস্ট থেকে সারা দেশে ধারাবাহিক কর্মসূচির পাশাপাশি ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণে ১৬টি সমাবেশ কর্মসূচি শুরু করেছিল বিএনপি।

এসব কর্মসূচি প্রতিহত করতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো পাল্টা কর্মসূচি দিলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। গত সোমবার দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর এক বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের অতি উৎসাহি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, কেউ বিএনপির কর্মসূচিতে অতি উৎসাহী হয়ে হামলার চেষ্টা করলে দলগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে কাউকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন কাদের।

এর আগে গত ৫ আগস্ট ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ভোলার ঘটনা কে ঘটিয়েছে, ভিডিও ফুটেজ দেখুন। কীভাবে ঘটেছে, কারা আক্রমণ করেছে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কারা মিছিল করেছে, কারা পুলিশের ওপর হামলা করেছে? পুলিশ কী করবে? আঙুল চুষবে?’ তিনি বলেন, ‘আবারো আগুন-সন্ত্রাস করে নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট এবং নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় বিএনপি। আমরা প্রস্তুত আছি।’ পরে ১৭ আগস্ট ওবায়দুল কাদেরের বহুল আলোচিত খেলা হবে, মোকাবিলা হবে বক্তব্য আসে।

ওইদিন দলীয় এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘বন্দুকের নল থেকে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়নি। রাজপথ থেকেই আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছে। খেলা হবে, খেলা। রাজপথে মোকাবিলা হবে। খেলা হবে নির্বাচনে, খেলা হবে রাজপথে। কী নিয়ে খেলবেন? ধরা খাবে বিএনপি।’ এর আগে ১৩ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে রাজপথের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। নৈরাজ্যের পথ ছেড়ে দিয়ে নির্বাচনের পথে হাঁটুন, নির্বাচনকে মোকাবিলা করুন। আগস্ট মাসটা যেতে দেন; তারপর টের পাবেন কত ধানে কত চাল।’

একই দিন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় আরেকটি আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বিএনপির প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘আমরা রাজপথে এখনো নামিনি; আগামী মাসে পরিপূর্ণভাবে নামব। রাজপথে নামলে বিএনপি পালানোর জায়গা খুঁজে পাবে না। সরকারি দল ও পুলিশের অব্যাহত হামলা-মামলার মুখে সারা দেশে কোণঠাসা হলেও বিএনপি নেতাদের পাল্টাপাল্টি হুংকার-হুঁশিয়ারিও থেমে নেই।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিলেও দলটির অন্য পর্যায়ের নেতারা ‘হামলা হলে’ ‘পাল্টা প্রতিরোধ’র ঘোষণা দিচ্ছেন। নেতাকর্মীদের সাহস জোগাতে সরকারি দলের ‘খেলা হবে’ বক্তব্যের জবাবে ‘পাল্টা খেলা হবে’ বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। নিজেদের নিরাপত্তায় ‘বাঁশের লাঠি’ হাতে নিতে বলেছেন কেউ কেউ।

এর মধ্যে গত ৪ সেপ্টেম্বর দলীয় এক সমাবেশে আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমাদের খালি হাত, আপনারাও খালি হাতে আসেন। পুলিশ ছাড়া আসেন। দেখি, কার কত ক্ষমতা! আর যদি বলেন লগি-বৈঠা; সেটাও সই। আমরা নিয়ে আসব।’ আর নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে যুবদল কর্মী শাওনের মৃত্যুর প্রতিবাদে আয়োজিত এক সমাবেশে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমাদেরও বন্দুকের লাইসেন্স দিন। আমরাও বন্দুকের লাইসেন্স চাই। বন্দুক দিয়ে বন্দুক মোকাবিলা করব। সমানে সমানে লড়াই হবে।’

গত বুধবার আরেক সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আন্দোলনের প্রস্তুতি ম্যাচ চলছে। ফাইনাল খেলা এখনো শুরু হয়নি। এর পর মোটা মোটা বাঁশের লাঠি নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। গত সোমবার মহাখালীর সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম বলেন, এখনো খেলা শুরু হয়নি। এটা ওয়ার্মআপ চলছে। আসল খেলা বাকি আছে এখনো।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, সংঘাত-সহিংসতাময় বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রধানতম উপায় হচ্ছে একে অপরের প্রতি গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ দেখানো এবং পরমতসহিষুষ্ণতা প্রদর্শন করা। একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতিও প্রত্যেককে শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।

তিনি বলেন, তবে বিএনপি দীর্ঘদিন পর মাঠে নামার সুযোগ পেলেও তাদের দলের মধ্যেও কিন্তু উগ্রপন্থিরা রয়েছে, যারা উসকানিমূলক বক্তব্য রেখে পরিস্থিতি আরো অসহনশীল করে তুলছেন। তাদের উসকানিমূলক বক্তব্য পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে যায়- এটা তাদের বুঝতে হবে এবং এমন অপতৎপরতা থেকে বিএনপিকেও সরে আসতে হবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ তো কোথাও হামলা করছে না; বরং বিএনপিই সারা দেশে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-সহিংসতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। তারা এমনকি পুলিশের ওপরও হামলা চালিয়ে উসকানিমূলক অপতৎপরতা চালাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ও বিশিষ্ট শিক্ষাবীদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, দেশ সংঘাতের দিকে যাক আমরা কেউ তা চাই না। কিন্তু বিএনপি তো সবসময় দেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলায়। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ করা তাদের পুরোনো অভ্যাস। এ বিবেচনায় এ দলটির শান্তির পথে আসা উচিত। তাছাড়া আওয়ামী লীগকেও শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিতে হবে। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক সহনশীলতার চর্চা জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version