-->

হঠাৎ কেন চাঙা বিএনপি

এম সাইফুল ইসলাম
হঠাৎ কেন চাঙা বিএনপি

রাজপথে দাবি আদায়ে হঠাৎ চাঙা হয়ে উঠেছে বিএনপি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনসহ কয়েক দফা দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ক্রমেই গতি পাচ্ছে দলটির। এক বছরের বেশি সময় বাকি থাকলেও বিএনপি চাঙা হওয়ার নেপথ্যে রাজনীতির মাঠে এখন নানা আলোচনা। অনেকেই বলছেন, ক্রমাগতভাবে নিত্যপণ্য, গ্যাস,জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও লোডশেডিংয়ের বিরূপ প্রভাব জনসাধারণের মাঝে সরকারবিরোধী মনোভাবে সহায়ক হচ্ছে। সাধারণ সভা-সমাবেশেও পুলিশের হয়রানি বিএনপি নেতাকর্মীদের সরকারবিরোধী অবস্থান তুঙ্গে তুলছে। এ ছাড়া আগামী সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে বিশেষ করে পশ্চিমা কূটনীতিকদের দৃশ্যমান তৎপরতায় বিএনপি নেতাকর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি ইসির কর্মকাণ্ডে মানুষের অনাস্থা তৈরি হওয়ায় বিএনপির দাবির যৌক্তিকতাও বেড়েছে।

 

বিএনপি নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকারের বেশিরভাগ কর্মকাণ্ডে মানুষ ক্ষুব্ধ। লোডশেডিং আর নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জাঁতাকলে থাকা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া বর্তমান ইসির কর্মকাণ্ডে অনাস্থা, নিরপেক্ষ নির্বাচন ও মানবাধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলের দৃশ্যভঙ্গির পরিবর্তন আর জনসাধারণের মাঝে সরকারবিরোধী মনোভাবের কারণেই বিএনপি নেতাকর্মীরা এখন পূর্বের তুলনায় অনেক চাঙা।

 

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে হেরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় হয় বিএনপির। যদিও বিএনপির অভিযোগ, ওই নির্বাচন ছিল একতরফা। তারপরও টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর বেশ সতর্কভাবে অনেকটাই একলা চলো নীতিতে এগোতে থাকে বিএনপি। ২০২০ থেকে শুরু করে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিশ^ব্যাপী করোনার থাবায় বিপর্যস্ত হয়ে সংকুচিত হয়ে আসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। তবে বছরের শেষ সময়ে এসে করোনাভাইরাসের প্রকট কমলে বেশ জোরেশোরে মাঠে নামে বিএনপি। বিশেষ করে অসুস্থ দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর দাবি ও দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামে বিএনপি। তাতে দেশব্যাপী বেশ সাড়া পায় দলটি।

 

২০২২ সালের শুরু থেকে বেশ জোরেশোরে বিএনপি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে তৎপর হয়। বছরের শুরু থেকে মিত্রদের নিয়ে ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গঠনে কাজ শুরু করে দলটি। পাশাপাশি ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি দেয় বিএনপি। জানা গেছে, জুলাই মাসের শুরু থেকে নানা কর্মসূচিতে মাঠে আছে বিএনপি। বিশেষ করে জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে দৃঢ়ভাবে মাঠে আছে বিএনপি। একই সঙ্গে ভোটাধিকার হরণসহ দলীয় নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন ইস্যুও রয়েছে। গত ২২ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী লাগাতার সভা, সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দেয় বিএনপি। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি সম্প্রতি ১৬ দিনের কর্মসূচি পালন করেছে। এসব কর্মসূচি পালনে নানা প্রতিকূলতার মাঝেও বিএনপি মাঠে ছিল।

 

ঢাকার কর্মসূচি শেষ করে বিএনপি ১০ সাংগঠনিক বিভাগীয় শহরে সমাবেশের ঘোষণা দেয়। বিভাগীয় সমাবেশ সফল করতে ১ অক্টোবর থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে বিভাগীয় ও জেলা নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও করে দলটি। বুধবার চট্টগ্রামে সমাবেশের মধ্য দিয়ে বিভাগীয় সমাবেশ শুরু হয়। আজ শনিবার ময়মনসিংহে বিভাগীয় সমাবেশ।

 

বিভাগীয় সমাবেশের মাঝেও বিএনপি আবারো দলটির সমমনা বা মিত্রদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার সংলাপ শুরু করেছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ দাবিতে মিত্রদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা ঠিক করতে বিএনপির এই সংলাপ। আগামী মাসের শুরুর দিকে আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করতে চায় বিএনপি।

 

একদিকে বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে বিএনপি কঠোর আন্দোলনের বার্তা তৃণমূলে পৌঁছে দিচ্ছে, অন্যদিকে আন্দোলনে মাঠে থাকবে এমন দলগুলোর সঙ্গে চলমান সংলাপে রূপরেখা চূড়ান্তের কাজ করছে বিএনপি। বিএনপি ও তার মিত্র দলের একাধিক নেতা বলছেন, ডিসেম্বরে বিভাগীয় সমাবেশ শেষ হলে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা অনুযায়ী এক দফার আন্দোলনে যাবে বিএনপি।

 

গত কয়েক মাসের কর্মপরিকল্পনা বিশ্লেষণ করলে বিএনপি এখন মাঠের আন্দোলনে বেশ চাঙা। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও মাঠের কর্মসূচি পালনে বিএনপি নেতাকর্মীদের চাঙা মনোভাব। বিএনপি হঠাৎ চাঙা হওয়ার নেপথ্যে কী- তা নিয়ে এখন রাজনীতির মাঠ থেকে শুরু করে জনসাধারণের মাঝে নানা রকমের আলোচনা চলছে।

 

বিএনপি নেতাকর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে জ¦ালানির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাওয়ার সব জিনিসের দাম বেড়েছে। পাশাপাশি ভোজ্যতেলের দামও দেশের বাজারে বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া আগেও দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি ছিল আলোচনায়। সবমিলিয়ে দেশে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাভিশ্বাস ওঠে। ফলে জনসাধারণের বেশিরভাগেরই সরকারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। এ ছাড়া লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে নাকাল মানুষ।

 

সম্প্রতি বিএনপির অনেক সভা-সমাবেশে পুলিশি বাধাও ছিল। পুলিশের সংঘর্ষে ভোলায় ছাত্রদল ও যুবদলের দুই নেতা, নারায়ণগঞ্জে যুবদল কর্মী ও মুন্সীগঞ্জে এক কর্মী নিহত হয়েছে। কর্মসূচি পালন করাকে কেন্দ্র করে নতুন করে দেয়া হচ্ছে মামলা। গ্রেপ্তারও করা হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের। সরকারের শেষ সময়ে পুলিশি হয়রানিতে বিএনপি নেতাকর্মীরা ভাবছেন আগামীতে এ সরকার ক্ষমতায় এলে তাদের ওপর প্রশাসনের কঠোর মনোভাব বাড়তে পারে। ফলে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ে তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করা উচিত।

 

এ ছাড়া বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো কর্মকাণ্ডে নেই বিএনপি। দলীয় সরকারের অধীনে এই কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না জানিয়ে দলটি এখন কোনো ভোটে অংশ নিচ্ছে না। এই ইসির অধীনে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ছাড়া যে কয়েকটি নির্বাচন হয়েছে, তার বেশিরভাগ ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে বুধবার গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচন নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন কমিশন উপনির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর লোকজন সকাল থেকেই বেশিরভাগ কেন্দ্র দখলে নিয়েছে এমন অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ভোট বন্ধ ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

 

বিএনপি নেতাকর্মীসহ অনেকেই এখন বলছেন, এই কমিশন একটি আসনের ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। সেখানে ৩০০ আসনের হাজার হাজার কেন্দ্রে কীভাবে নিরাপত্তা দেবে? এ ছাড়া কয়েকদিন আগে ইসির সঙ্গে বৈঠকে একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ডিসি-এসপিদের তোপের মুখে পড়েন কমিশনার আনিছুর রহমান। এরপর থেকে তিনি অফিস করছেন না। এ ক্ষেত্রেও মাঠ প্রশাসনের কাছে ইসির অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অনাস্থা সৃষ্টি হওয়ায় বিএনপির দাবি জোরালো হচ্ছে।

 

২০২১ সালের শেষের দিকে র‌্যাবের ৭ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন ও পশ্চিমাদের মনোভাবের প্রকাশ পায়। পশ্চিমা কূটনীতিকরা আগামী সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে বেশ সরব। আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার ব্যাপারে বেশ জোরালো কথা বলছেন তারা। সম্প্রতি ব্রিটিশ হাইকশিনার রবার্ট সি ডিকসন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস, ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হুইটনি একাধিক অনুষ্ঠানে আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ ও প্রকৃতপক্ষে অংশগ্রহণমূলক করতে সরকারের উদ্দেশে কথা বলেছেন।

 

এ ছাড়া গত কয়েকদিনে জাপান ও জার্মান রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন করতে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচন ইস্যুতে বাইরের কূটনীতিকদের ভূমিকাকে সরকার যে খুব একটা ভালোভাবে নিচ্ছে না, তার বড় প্রমাণ বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বক্তব্যে বোঝা গেছে। তিনি বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো কূটনীতিক শিষ্টাচার না মানলে সরকার ‘অন্য দৃষ্টি’ দেবে। বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা কূটনীতিকদের স্পষ্ট ভূমিকা সরকারবিরোধীদের মনোবল চাঙা করছে বলে নানা আলোচনা আছে।

 

যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও দলটির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, মাঠের আন্দোলনে এখন নেতাকর্মীরা চাঙা। সুশাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে নাভিশ^াস ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের অনাস্থা এখন সরকারের বিরুদ্ধে। তাই বিএনপির সভা-সমাবেশে মানুষের ঢল।

 

বিষয়টি নিয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, জনগণই হচ্ছে রাজনৈতিক দলের একমাত্র শক্তি। জনগণ এখন এই সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ও দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকলে পড়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন। তিনি বলেন, বিএনপি ভাত ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে মাঠে নেমেছে। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকতেই পারে।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে অগণতান্ত্রিক সরকার চেপে বসলে তাদের সরাতে আন্দোলনের পাশাপাশি বিশে^র গণতন্ত্রমনাদের ভূমিকা থাকে। তার দাবি- দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অব্যাহত লোডশেডিং, নেতাকর্মীদের পুলিশের হয়রানি ও বিএনপিসহ সরকারবিরোধীদের মনোভাব ক্রমেই চাঙা হচ্ছে। গত বুধবারের চট্টগ্রামের গণসমাবেশের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্দোলনেই সরকার পতন হবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

 

মন্তব্য

Beta version