-->
নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন

ঘুরেফিরে হাস্যরসের বাহারি নাম

শাহীন রহমান
ঘুরেফিরে হাস্যরসের বাহারি নাম

‘নাকফুল বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ ইত্যাদি পার্টি’, ‘মুসকিল লীগ’, ‘বেকার সমাজ’, নৈতিক সমাজ, ‘বৈরাবরী’, ‘গরীব পার্টি’, ‘বাংলাদেশ পিপলস পার্টি-বিপিপি’, ‘বাংলাদেশ জাতীয় লীগ’, ‘বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলন’, বাংলাদেশ সৎ সংগ্রামী ভোটার পার্টি, ‘ফরওয়ার্ড পার্টি’-ইত্যাদি

 

শাহীন রহমান: সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। ২০০৮ সাল থেকে চালু হয় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন। বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধন আছে ৩৯ দলের। নতুন ইসির দায়িত্ব নিয়েই এবারো নতুন দলের নিবন্ধনের আহ্বান জানায় ইসি। ইসির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৯৮টি দল আবেদন জানিয়েছে। দলগুলোর নাম যেমন বাহারি; আবার হাস্যরসেরও জন্ম দিচ্ছে। তবে এ ধরনের এবং এত অধিক রাজনৈতিক দল বারবার নিবন্ধনের জন্য আবেদন করায় ইসির কর্মকর্তারাও বিস্মিত হয়েছেন। তারা জানান, নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা বেশিরভাগ দলই নাম ও প্যাডসর্বস্ব। আবেদনের সঙ্গে নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত জমা দেয়নি অনেক রাজনৈতিক দল। তবে সব দলের আবেদন সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করতে ইসি একটি কমিটি গঠন করেছে।

 

ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন জানিয়েছে ‘নাকফুল বাংলাদেশ’ নামের একটি দল। ২০১৮ সালেও দলটি নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। কিন্তু শর্ত পূরণ না হওয়ায় নিবন্ধন পেতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু তখন নামটি বেশ হাস্যরসের জন্ম দেয়। নিবন্ধন পেতে দলটি আবার এসেছে ইসিতে আবেদন নিয়ে। নাম শুনলে যে কারো হাসি পাবেই। শুধু ‘নাকফুল বাংলাদেশ’ নয়, হাস্যকর নামের তালিকা এবার আরো দীর্ঘ। তালিকায় বাংলাদেশ ইত্যাদি পার্টি, মুসকিল লীগ, বেকার সমাজ, নৈতিক সমাজ, বৈরাবরী, গরীব পার্টি, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি-বিপিপি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলন, বাংলাদেশ সৎ সংগ্রামী ভোটার পার্টি, ফরওয়ার্ড পার্টির মতো বিভিন্ন নামের দলগুলোর আবেদন জমা পড়েছে।

 

ইসির যুগ্ম সচিব এসএম আসাদুজ্জামান বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালেও নামসর্বস্ব ৭৬ দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। সে সময় কিছু হাস্যকর নাম ছিল। কিন্তু এবার সংখ্যাটা বেশি। ওই সময় নাকফুল বাংলাদেশ, ঘুষ নির্মূল পার্টিসহ অদ্ভুত নামে অনেক রাজনৈতিক দল আবেদন করেছিল।

 

জানা গেছে, যেসব দল এবার ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে, তার বেশিরভাগই নামসর্বস্ব। নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলেও এসব দলের যেমন নেই কোনো কেন্দ্রীয় কার্যালয়, কোনো কোনো দলের নেতার বাড়ির ঠিকানাকেই দলীয় ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আবার অনেক দল প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তও জমা দিতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই এক ধরনের রাজনৈতিক দলকে তৎপর হয়ে উঠতে দেখা যায়। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব দলের নির্বাচনের সময় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার লক্ষ্য থাকে সবসময়। নিবন্ধনের বিধান চালু হওয়ার পর থেকে দেখা গেছে এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনার যোগ্য নয়। তারপর নির্বাচন এলেই নিবন্ধনের জন্য লাইন দিতে শুরু করে।

 

তবে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে যারাই আবেদন করুক না কেন, তাদের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পরই কেবল নিবন্ধন দেয়া হবে। যাদের নিবন্ধন দেয়া হবে তারা আগামীতে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচন করতে পারবেন। তারা জানান, আগামী বছরের জুনের মধ্যে নতুন দলের নিবন্ধন চূড়ান্ত করা হবে। এ জন্য নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন যাচাই-বাছাইয়ে একটি কমিটিও করা হয়েছে। এ কমিটির সদস্য সচিব আব্দুল হালিম খান বলেন, ইসির কাছে যে ৯৮টি আবেদন জমা পড়েছিল, নাম দ্বৈততার কারণে পাঁচটি বাদ দিয়ে ৯৩টি আবেদন এখন বিবেচনায় রয়েছে। সব আবেদন গুছিয়ে প্রাথমিক কাজগুলো করার পর নির্বাচন কমিশনে উপস্থাপন করা হবে। কমিশন পর্যালোচনার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এখনো মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নেয়ার কাজ শুরু হয়নি। যখনই কমিশন নির্দেশনা দেবে, তখনই নিবন্ধন শর্ত সঠিক রয়েছে কিনাÑ তার তথ্য সংগ্রহে কাজ শুরু হবে।

 

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, কমিশনের তিনটি শর্তের মধ্যে একটি পূরণ হলে একটি দল নিবন্ধনের যোগ্য বিবেচিত হয়। শর্তগুলো হলো- ১. দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কোনো জাতীয় নির্বাচনে আগ্রহী দলটির যদি অন্তত একজন সংসদ সদস্য থাকে, যে কোনো একটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী অংশ নেয়া আসনগুলোয় মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ পায় এবং দলটির যদি একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ (২১টি) প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি এবং অন্তত একশটি উপজেলা/মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন সংবলিত দলিল থাকে। তবে ইসি কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীনতার পর একটি আসন পাওয়া এবং কোনো নির্বাচনে দলের শতকরা ৫ শতাংশ ভোট পাওয়ার শর্তটি ২০০৮ সালের পরে আর প্রযোজ্য নয়। ফলে নতুন দলের নিবন্ধন পেতে হলে তৃতীয় শর্ত পূরণ করতে হবে।

 

এর আগে ২০১৮ সালে কে এম নুরুল হুদা কশিনের সময়ও নিবন্ধন পেতে ৭৬টি দল আবেদন করেছিল। তখন এ ধরনের বাহারি নামের দলগুলো বেশ হাস্যরস সৃষ্টি করে। তবে ইসির যাচাই-বাছাইয়ে শর্ত পূরণ না হওয়ায় কোনো দলকেই তখন নিবন্ধন দেয়া হয়নি। তখনো ইসির তালিকায় যেসব বাহারি নামের দল আবেদন করেছিল, তার মধ্যে ছিল নাকফুল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নিউ সংসদ লীগ, ঘুষ নির্মূল পার্টি, মঙ্গল পার্টি, কর্মসংস্থান আন্দোলন, বাংলাদেশ সমাধান ঐক্য পার্টি (বসবাস), সোনার বাংলা উন্নয়ন লীগ, সত্যব্রত আন্দোলন, সততা দল, জাতীয় পরিবার কল্যাণ পার্টি, শান্তির দল, জনতার কথা বলে, মৌলিক বাংলা, জনস্বার্থে বাংলাদেশ, সুশীল সামাজিক আন্দোলন, বাংলদেশ আলোকিত পার্টি, বাংলাদেশ মঙ্গল পার্টি, বাংলাদেশ সমাজ উন্নয়ন পার্টি (বিএসডিপি), বাংলাদেশ নিউ সংসদ লীগ (বিএনএসএল), তৃণমূল ন্যাশনাল পার্টি, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গণশক্তি দল, বেঙ্গল জাতীয় কংগ্রেস (বিজেসি), বাংলাদেশ জনতা ফ্রন্ট, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি, বাংলাদেশ রামকৃষ্ণ পার্টি, মুক্ত রাজনৈতিক আন্দোলন, নতুন ধারা বাংলাদেশ (এনডিবি), সাধারণ জনতা পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা কমিউনিজম ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও মৌলিক বাংলা দল। তবে ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, এই তালিকা এবার আরো বড়। ঘুরেফিরে নিবন্ধনের জন্য আসা এসব দল বারবার জনগণের হাসির খোরাকে পরিণত হচ্ছে।

 

ইসিতে নিবন্ধন পেতে এবার আবেদন জানিয়েছে বাংলাদেশ ইত্যাদি পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান সাগর ওরফে ইত্যাদি সাগর। নিজের নামটাও দলের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ইত্যাদি সাগর নামে সবাই জানে। এই নামে আমি বেশ জনপ্রিয়। নিবন্ধন পেলে আগামী সংসদে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেব। নিবন্ধন পাওয়ার ব্যাপারে তার ‘আত্মবিশ্বাস’ রয়েছে। নিবন্ধন পাওয়ার জন্য কমিশনে যে শর্ত রয়েছে, তার দলের জন্য এসব প্রয়োজন নেই বলেও উল্লেখ করেন।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version