শাহীন রহমান: সম্প্রতি ‘ইভিএমে ভোট পুনর্গণনা করে ফলাফল একই পেয়েছে’ এমন তথ্য প্রচার করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইভিএমে ভোট পুনর্গণনা করা যায়। তবে সে প্রযুক্তি দেশে নেই। এটি ব্যবহার করা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল বিষয়। তবে তারা বলছেন, দেশে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, তার মধ্যে ভোটার ভেরিফায়েড ডিজিটাল অডিট ট্রেইল থাকে। এই সিস্টেমে ভোট পুনর্গণনার প্রয়োজন পড়ে না। ভোট স্বয়ক্রিয়ভাবে মেমোরিতে চলে যায়। পরে তা সংরক্ষণ করা যায়।
ইসির ইভিএম কারিগরি বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ভারতের নির্বাচনে যে ইভিএম ব্যবহার হয়, তার সঙ্গে থাকে ভিভিপ্যাট (ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল) যার মাধ্যমে ভোট দেয়া নিশ্চিতের পাশাপাশি ভোট গণনার সুযোগও থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের ইভিএমে ভিভিড্যাট (ভোটার ভেরিফায়েড ডিজিটাল অডিট ট্রেইল) থাকে। এখানে ভোট কনফার্মের পরপরই সব তথ্য মেমোরিতে চলে আসে। আর অডিট কার্ডে কেন্দ্রের একীভ‚ত ফল সংরক্ষিত থাকে। এমন পরিস্থিতিতে মেমোরি কার্ডের পুনঃভোট গণনায় প্রতি ভোটের তথ্য প্রিন্ট করার বিষয়টিও বেশ জটিল। এই সিস্টেমে ইভিএমে পুনর্গণনার প্রয়োজন পড়ে না।
দেশে ইভিএম যন্ত্র প্রথম চালু হয় ২০১০ সালে। ওই সময় নির্বাচন কমিশন দেশে ইভিএম ব্যবহার করে পরীক্ষামূলক ভোট নেয়া শুরু করে। এরপর থেকেই প্রতিটি নির্বাচনে পর্যায়ক্রমে ইভিএমের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রায় ১৫০ আসনে ভোট ইভিএমে নেয়ার পুরো প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু কমিশনের এ সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক অঙ্গন এবং বিশেষজ্ঞ মহলে বেশ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে।
বিএনপিসহ কিছু বিরোধী রাজনৈতিক দল ইভিএমের ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে সব আসনে ইভিএমেই ভোট চায়।
বিরোধী পক্ষের দাবি, ইভিএমে কারচুপি করা যায়। একই সঙ্গে ফল পাল্টে দেয়া সম্ভব। আবার ইভিএম হ্যাক করে তৃতীয় পক্ষ এর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। ফলে তারা তাদের মতো ফল সাজাতে পারে।
তবে ইভিএমের প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাকিব বলেন, ইভিএমে মোট ভোটের পাশাপাশি প্রতিটি ভোটের তথ্যও প্রিন্ট করা হয়তো সম্ভব। কোন বুথে কে কত ভোট পেল, তার মোট সংখ্যাটার সামআপ রেজাল্টই জানা যায় ইভিএমে। আরো ডিটেইলস হয়তো সম্ভব।
ইভিএমের কারিগরি বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ইভিএমে ভোট পুনর্গণনা চাইলে পোলিং কার্ড ধরে এক একটি করে সবকিছু প্রিন্ট করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে হাজার হাজার কপি প্রিন্ট করতে হবে। অনেক তথ্যই মেমোরি কার্ডে থাকে। কতটুকু প্রিন্ট করতে চান, সেটা বিষয়। ভারতের নির্বাচনে যে ইভিএম ব্যবহার হয়, তার সঙ্গে থাকে ভিভিপ্যাট (ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল), যার মাধ্যমে ভোট দেয়া নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ভোট গণনার সুযোগও থাকে। সেখানে ভোটার ইভিএমে ভোট দেয়ার পর মেশিন থেকে একটি কাগজ প্রিন্ট হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাশের বাক্সে পড়ে। অনেকটা কাগজের ব্যালট পেপারটি মুড়িয়ে বাক্সে ফেলার মতো। ফলে ইভিএমে যেমন ফল দেখা যায়, চাইলে ওই পেপার ট্রেইল গণনা করেও দেখার সুযোগ থাকে। সেখানে প্রতি ভোটের তথ্য ইভিএমের পাশাপাশি কাগজেও প্রিন্ট থাকে। তাতে পুনর্গণনার মতো চ্যালেঞ্জেও যেতে হয় না।
দেশে ব্যবহৃত ইভিএম সুরক্ষার বিষয়টি নিয়েও সাংবাদিকদের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার কথা বলেছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। তিনি বলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) চিপস এমনভাবে তৈরি যে, এটা একবারই ব্যবহারযোগ্য। এখানে রিরাইট করার যেমন সুযোগ নেই, প্রোগ্রামিং পরিবর্তন করারও কোনো সুযোগ নেই। অনেকেই বলেন যে, এটা একটা কারচুপির মেশিন। আসলে ইভিএমে কারচুপির কোনো সুযোগ নেই। প্রোগ্রামিং করে ফল উল্টিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। ইসি যে ইভিএম ব্যবহার করছে, তা ভিন্ন ধরনের। ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের সঙ্গে এটা তুলনা করা যাবে না।
ভারতের ইভিএমে ভোটার শনাক্ত করা হয় ম্যানুয়ালি। আমাদের ইভিএমে শনাক্ত করা হয় ডিজিটালি। যেহেতু আমাদের ভোটার ডাটাবেজ ছবি এবং ফিঙ্গার প্রিন্টসহ। কাজেই ভোটার এলেই এই কেন্দ্রের ভোটার আসলে কি ভোটার না অন্য কোনো ব্যক্তি; এটা মেশিনই শনাক্ত করে। যেটা ভারতের ইভিএমে করার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, ইভিএমে যে প্রোগ্রামিং করা হয়েছে, তাতে শুধু যোগ করতে পারে। প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট যোগ করতে পারে। আর কিছু করতে পারে না। প্রোগ্রামিংটা ওইভাবে করা। কাজেই কেউ যন্ত্রে বা বাইরে থেকে ম্যানিপুলেশন করবে সে সুযোগ নেই। কারণ এটাতে যে চিপস ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে রাইট করা হয়, এটা হলো ওয়ানটাইম ইউজেবল। কাজেই একবার রাইট করা গেলে রিরাইট বা এডিট করার কোনো সুযোগ থাকে না যোগ করেন তিনি।
ইন্টারনেটের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই। ব্যালট ইউনিটের সঙ্গে যে সংযোগ দেয়া হয়, এটা কিন্তু কাস্টমাইজ করা। বাজারে কেনা কোনো কেবল, ড্রাইভ কোনো কিছুই এটার মধ্যে প্রবেশ করাতে পারবেন না। কেবল এই ইভিএমের জন্য যে ডিভাইস তৈরি করা হয়েছে, সেটা ছাড়া আর কোনো ডিভাইস যোগ করতে পারবেন না। ম্যানিপুলেট করতে হলে বারেবারে প্রোগ্রাম পরিবর্তন করতে হবে। সে সুযোগ নেই এই ইভিএমে। এটা অনেকটা ক্যালকুলেটরের মতো। প্রোগ্রাম পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ইভিএমে ভোট নেয়ার সুবিধা হলো ভোটার ছাড়া ভোট দেয়ার সুযোগ নেই। একটা দুর্বলতা আছে, গোপন বুথে যদি ভোটারকে ঢুকতে না দেয়া হয়, এই সুযোগটা আছে। তবে ভোটার যদি কেন্দ্রে না আসেন তবে সে সুযোগ নেই।
সম্প্রতি নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনালের একটি রায়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) গৃহীত ভোট পুনর্গণনা করার পর তা নিয়ে চলছে আলোচনা। ইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাগজের ব্যালটে যেভাবে প্রতিটি ভোট পুনর্গণনা হয়, ইভিএমের ক্ষেত্রে সেভাবে হয়নি। এখানে শুধু কেন্দ্রের সমন্বিত ফল যোগ করা হয়েছে মাত্র।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইভিএমেও প্রতিটি ভোট পুনর্গণনা সম্ভব। তবে তা অর্থ ও সময়সাপেক্ষ। তারাও বলছেন, ইভিএমে ভোটের ফলাফলের তথ্য সংরক্ষণ থাকে ‘অডিট কার্ডে’। এ তথ্য কোনোভাবে জালিয়াতি করা সম্ভব নয়। সমন্বিত ফলটি ভোটের পরে দুই বছর, পাঁচ বছরও সংরক্ষিত করে রাখা যায়। এ যন্ত্রে রয়েছে দুটি ডিভাইস। ব্যালট ইউনিট, যা ভোটার ভোট দেয়ার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র বা ডিভাইস। আর কন্ট্রোল ইউনিট- ভোটার শনাক্তকরণ, ইলেকট্রনিক ব্যালট ইস্যু ও ভোট দিতে তথ্য সংরক্ষণ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র বা ডিভাইস।
তারা জানান, ভোটের কাজে তিন ধরনের কার্ড ব্যবহার হয়। এর মধ্যে একটি থাকে ‘অডিট কার্ড। এর মাধ্যমে ইভিএম পরিচালনা করা হয়। এই কার্ড ভোট শেষে কেন্দ্রে ফল প্রকাশের কাজে ব্যবহৃত হয়। পোলিং কার্ডে ভোট নেয়ার যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণের জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও থাকে এসডি কার্ড। এটি তথ্য ধারণের জন্য ব্যবহৃত মেমোরি কার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তারা বলেন, ইভিএমে ভোট শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফল চলে আসে। ভোট নিশ্চিত হওয়ার পর তা সরাসরি মেমোরি কার্ডে চলে যায়, সেখানে তথ্য জমা থাকে। কোনো ভোটের জন্য এই কার্ড একবারই ব্যবহার করা হয়। ভোট শেষে এই কার্ড ইসি সংরক্ষণ করে থাকে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। ফলে ইভিএমে কারচুপির সুযোগ নেই।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য