-->
গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচনে অনিয়ম

কঠোর শাস্তির আওতায় ১৩৪ কর্মকর্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক
কঠোর শাস্তির আওতায় ১৩৪ কর্মকর্তা

গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৩৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তদন্তে নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং দায়িত্ব পালনে যাদের বিরুদ্ধে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং ইসির নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও যারা মানেনি তারা এই শাস্তির আওতায় আসছেন।

 

কঠোর শাস্তির আওতায় আসছেন খোদ এই আসনের উপনির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সাইফুল ইসলামও। রিটার্নিং অফিসার ছাড়াও তালিকায় আরো আছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, প্রিসাইডিং অফিসার, পুলিশের উপপরিদর্শক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আছেন শতাধিক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা। এ ছাড়াও প্রার্থীর এজেন্ট হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

 

এর মধ্যে ইসি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে বিভাগীয় ব্যবস্থা। এর বাইরে যারা আছেন তাদের বিরুদ্ধে স্ব স্ব নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থা নিয়ে ইসিকে অবহিত করবে। বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা ব্যতীত অন্য সংস্থা বা বিভাগ থেকে নির্বাচনে দায়িত্বে আসা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্ব স্ব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে এক মাসের মধ্যে ইসিকে অবহিত করতে হবে। নির্বাচন চলাকালে যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে, সেখানে যারা নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন, তাদের তালিকা ইসির কাছে আছে। তালিকা দেখে অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

ইসি রিটার্নিং কর্মকর্তা ছাড়া অন্য যাদের বিরুদ্ধে ইসি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে আছেন গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), ১ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ১২৬ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পুলিশের ৫ উপপরিদর্শক (এসআই)। গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (সার্বিক) বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর বিধান অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেবে ইসি।

 

প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের মধ্যে ১২৫ জনের বিরুদ্ধে একই আইন অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ইসি চিঠি দেবে। এ ছাড়া একজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ৫ জন এসআইয়ের বিরুদ্ধে একই আইন অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেবে ইসি। তবে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

 

সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেন, একজন প্রিসাইডিং অফিসারকে দুই মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করার পাশাপাশি পুলিশের পাঁচজন এসআইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হবে। ১২৫ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ে, এডিসি ও একজন নির্বাহী হাকিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করবে ইসি। আর ১৪৫ কেন্দ্রের নির্বাচনী এজেন্টদের আর কখনো ভোটের দায়িত্ব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সিইসি বলেন, সুপারিশ অনুযায়ী সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো কিনা, এক মাসের মধ্যে তা কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে।

 

গত ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের মধ্যে সিসি ক্যামেরায় পুরো আসনের এক-তৃতীয়াংশ কেন্দ্রে অনিয়মের দৃশ্য দেখে মাঝপথে ঢাকা থেকে নির্বাচন বন্ধের নির্দেশ দেয় ইসি। এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল অনিয়মে সম্পৃক্তদের চিহ্নিত করতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। তদন্ত কমিটি ছয় শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য নিয়ে প্রতিবেদন দেয়, যার ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ওই দিন গাইবান্ধা উপনির্বাচনে ভোট শুরুর পরই পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ইসি থেকে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে বারবার। কিন্তু প্রিসাইডিং অফিসার থেকে মাঠ প্রশাসন কেউ ইসির নির্দেশ আমলে নেয়নি। অবশেষে বাধ্য হয়েই নির্বাচন ভবনে বসেই ভোট বন্ধ করতে হয়েছে ইসির।

 

গাইবান্ধায় নির্বাচন বন্ধের পর অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন করা সম্পর্কে ইসি মো. আলমগীর বলেছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পিছ পা হবে না নির্বাচন কমিশন। অপরাধ প্রমাণ হলে চাকরিচ্যুতি থেকে বরখাস্ত করার মতো শাস্তি গ্রহণ করা হবে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে প্রথমে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আহ্বান জানানো হবে। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যদি ইসির কথা না শোনে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরো উল্লেখ করেন, সিসি ক্যামেরায় অনিয়ম দেখার পর প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। তারা কথা শোনেনি। তাদের বামে যেতে বলা হয়েছে। ডানে গেছেন। ডানে যখন যেতে বলা হয়েছে বামে গেছেন। এভাবে ইসির নির্দেশনা অমান্য করা অপরাধ।

 

গাইবান্ধা উপনির্বাচন বন্ধের পর অনিয়ম তদন্তে ইসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শুধু ৫১ কেন্দ্রে নয়, নির্বাচনের অধিকাংশ কেন্দ্রে অনিয়ম পাওয়া গেছে। গত ১৫ নভেম্বর ইসিতে জমা দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কেবল ভোট বন্ধ হওয়া ৫১টি কেন্দ্র নয়, গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের বাকি ভোটকেন্দ্রের প্রায় সবগুলোর চিত্রও একই ধরনের। এসব কেন্দ্রে অনাকাক্সিক্ষত জনগণের প্রবেশ, ভোটারদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোটদানে বাধ্য করা বা প্রভাবিত করা, মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে গোপন কক্ষের ছবি ধারণসহ নানা অনিয়মের তথ্য পেয়েছে। ইসির গঠিত তদন্ত কমিটি বাকি ৯৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ৮৭টির সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এসব অনিয়ম পেয়েছে বলে তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

 

অনিয়মে জড়িতদের শাস্তি প্রদানে ১০ সিদ্ধান্ত : প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বৃহস্পতিবার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের কাছে ইসির সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন। অপর নির্বাচন কমিশনাররা এবং ইসি সচিব এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

 

তদন্তে প্রমাণিত যে, ১২৫টি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন। সে সকল কর্মকর্তার নামের তালিকা সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫ অনুযায়ী তাদের স্ব-স্ব নিয়ন্ত্রণকারী/নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করবে। নিয়ন্ত্রণকারী/নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালনে অবহেলা তথা অসদাচরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে এক মাসের মধ্যে অবহিত করবে।

 

কেন্দ্র নম্বর ৯৪-এর প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম, প্রভাষক উদয়ন ডিগ্রি কলেজকে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫(৩) অনুযায়ী চাকরি থেকে ২ মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে। সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে তার বিরুদ্ধে অসদাচরণের জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এক মাসের মধ্যে কমিশনকে অবহিত করবে মর্মে পত্র দেবে।

 

একইভাবে সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় কেন্দ্র নম্বর ২ (তরুণ কুমার, এসআই. গোবিন্দগঞ্জ থানা), কেন্দ্র নম্বর ৫৪ (মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, এসআই গোবিন্দগঞ্জ থানা), কেন্দ্র নম্বর ৫৯ (মো. আনিছুর রহমান, এসআই গোবিন্দগঞ্জ থানা), কেন্দ্র নম্বর ৬২ (কনক রঞ্জন বর্মন, এসআই সাদুল্যাপুর থানা) ও কেন্দ্র নম্বর ১০৫ (মো. দুলাল হোসেন, এএসআই, আটোয়ারী থানা, পঞ্চগড়)-এর পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে অবহেলা তথা অসদাচরণের কারণে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫ অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে পত্র দেবে। কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে এক মাসের মধ্যে অবহিত করবে।

 

অতিরিক্ত জেলা প্রশাশক (সার্বিক) সুশান্ত কুমার সাহার বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫ অনুসারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অসদাচরণের জন্য ব্যবস্থা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে এক মাসের মধ্যে অবহিত করার জন্য সচিব নির্বাচন কমিশন সচিবালয় কর্তৃক পত্র দিতে হবে।

 

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সহকারী কমিশনারের নাম জেনে (এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল নম্বর ০১৭২৬৩৪১৩৭৭। তদন্ত প্রতিবেদনে নাম উল্লেখ করা হয় নাই) তাকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অবৈধ আদেশ পালনের জন্য ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে পত্র প্রদান করবে।

 

রিটার্নিং কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের (আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, রাজশাহী) বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫ অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য তার বিরুদ্ধে সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এক মাসের মধ্যে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে কমিশনকে অবহিত না করলে কমিশন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৬(২) অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

 

সব কেন্দ্রের দায়িত্ব পালনকারী নির্বাচনী এজেন্টদের তালিকা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কর্তৃক সীলকৃত ব্যাগে রয়েছে, যেহেতু নির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে এবং এ বিষয়ের ওপর আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, তাই যেসব কেন্দ্রের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে সেসব কেন্দ্রের ব্যাগ খুলে দায়ী এজেন্টদের একটি তালিকা তৈরি করতে হবে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, গাইবান্ধা এই তালিকা করবেন। ভবিষ্যতে নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়ম করা হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোরতম ধারায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

সিইসি বলেন, যারা বিভিন্ন প্রার্থীদের এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের শনাক্ত করে পরে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গাইবান্ধা-৫ আসনের পুনর্নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version