নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে ‘ক্রাইম সিন’ ঘোষণা করেছে পুলিশ। পুলিশি ভাষা বা আইনের ভাষায় প্লেস অব অকারেন্স ‘পিও’ আখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, যেহেতু বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে, পাশাপাশি পরিচালিত অভিযানে বোমা উদ্ধার করা হয়েছে, সেহেতু আমরা এটিকে ক্রাইম সিন ঘোষণা করেছি। আমাদের বোম্ব ডিসপোজাল ও সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। সেহেতু এখানে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত কাজ শেষ না হবে ততক্ষণ এখানে বা এ এলাকায় কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।
এদিকে নয়াপল্টনসহ আশপাশের পুরো এলাকা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। রাজধানীর বিজয়নগরের রাস্তার নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে পুলিশ হাসপাতাল পর্যন্ত রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রাখলেও বিকেল ৪টার পর খুলে দেয়া হয়। পাশাপাশি পুলিশের সাঁজোয়া যানগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় কার্যালয়ে যেতে চাইলে পুলিশ তাকে বাধা দেয়। পরে তাকে আর যেতে দেয়া হয়নি। এরপর দুপুর ১২টার দিকে নাইটিঙ্গেল মোড়ে কিছু বিএনপি কর্মী সমবেত হয়ে স্লোগান দেয়া শুরু করলে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে ৪ জনকে আটক করে। এরপর সারাদিন বিএনপি কর্মীদের আর কোনো আনাগোনা দেখা যায়নি।
সরেজিমনে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই নাইটিঙ্গেল মোড়ে বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি। দেয়া রয়েছে ব্যারিকেড। কোনো সাধারণ মানুষকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। তবে এ এলাকায় কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি অফিস ও ব্যাংক থাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে। চলমান এসএসসি পরীক্ষার্থীরাও যাতায়াতের সুযোগ পেয়েছেন।
পল্টন থানা পেরিয়ে পুলিশ হাসপাতালের সামনেও দেয়া রয়েছে ব্যারিকেড। সেখানেও বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্যের উপস্থিতি ছিল। পাশাপাশি পুলিশের সাঁজোয়া যান হিসেবে পরিচিত এপিসি, জলকামানও মোতায়েন ছিল সেখানে। পোশাকে পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও ছিলেন সক্রিয়।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নাইটিঙ্গেল মোড় দিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাকে বাধা দেয়। পরে তিনি আর অফিসে যেতে পারেননি।
বেলা ১১টার পর বিএনপির ২০/২৫ কর্মী সেখানে স্লোগান দিতে থাকলে পুলিশ চড়াও হয়। একসময় তাদের ধাওয়া দিয়ে সেখান থেকে চারজনকে আটক করে। পরে বেলা যত গড়িয়েছে পুলিশের উপস্থিতি বাড়লেও বিএনপি কর্মীদের এ এলাকায় আর দেখা যায়নি। তবে কিছু উৎসুক জনতাকে বন্ধ রাস্তার দুপাশেই দেখা গিয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়টির সামনে পুলিশের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল। বিভিন্ন অলিগলিতেও বিপুল সংখ্যক পুলিশ ছিল।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপস) বিপ্লব কুমার সরকার বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত এ এলাকা (পল্টন) আমরা নিরাপদ মনে না করব, ততক্ষণ পর্যন্ত এ এলাকায় যান চলাচল এবং জনসাধারণের চলাচল বন্ধ থাকবে। আমরা কোনো ব্যক্তিকে টার্গেট করে আটকাচ্ছি না। তবে এখানে এ মুহূর্তে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই।
বিপ্লব কুমার বলেন, বিএনপির দলীয় কার্যালয়কে আমরা এখন আইনের ভাষায় বলছি, প্লেস অব অকারেন্স (পিও)। যে কারণে আমরা বিএনপির দলীয় কার্যালয় কর্ডন করে রেখেছি। বিশেষজ্ঞ ব্যতীত, ক্রাইম সিনের লোকজন ব্যতীত কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত পুলিশের কাজ শেষ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এখানে কোনো কিছুই হতে দেয়া হবে না।
তিনি আরো বলেন, আমরা (পুলিশ) গতকাল সতর্কতামূলক অবস্থানে ছিলাম। কাউকে মারধর, হামলা করার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু একপর্যায়ে যখন বিএনপির নেতাকর্মীরা রাস্তা ব্লক করে অবস্থান নেয়, জনসাধারণের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার রাস্তা ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। একপর্যায়ে ডিসি মতিঝিলসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা হয়। যখন পুলিশের ওপর হামলা হয়, তখন জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে বাধ্য হয়েছি অভিযান পরিচালনার জন্য। পুলিশের ওপরে হামলা হয়েছে, ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে, নাশকতার চেষ্টা হয়েছে, নাশকতার সব ধরনের উপকরণ এখানে আনা হয়েছিল বলেও আমরা জানতে পারি। পরিচালিত অভিযানে নাশকতার যাবতীয় উপাদান আমরা এখান থেকে জব্দ করেছি।
বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে নাশকতার উপাদান পাওয়া যায়, ককটেল পাওয়া যায়। এটা খুবই দুঃখজনক বিষয় যে, এটা রাজনৈতিক কোনো সংস্কৃতির মধ্যেই পড়ে না। ককটেল রাখার জায়গা হিসেবেই আমরা এখন বিএনপি কার্যালয়কে ট্রিট করছি। আমাদের ক্রাইম সিন ইউনিট কাজ করছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপাতত এ এলাকায় যান চলাচল এবং জনসাধারণের চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলীয় কার্যালয় ছাড়াও এখানে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস, বাসাবাড়ি রয়েছে। তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হচ্ছে। তাদের নিরাপত্তা বিধান করা পুলিশের পবিত্র দায়িত্ব। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য যা যা প্রয়োজন, পুলিশের পক্ষ থেকে তাই করা হবে। গতকালের ঘটনায় এ পর্যন্ত তিন থেকে চারশ লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সমাবেশের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বলেন, এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। যারা সমাবেশের আয়োজন করেছেন, তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। জনসাধারণের চলাচল বিঘ্নিত হয়, এমন কোনো স্থানে সমাবেশের অনুমতি দেবে না ডিএমপি।
মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেকগুলো মামলার প্রক্রিয়া চলছে, বিস্ফোরক, নাশকতার চেষ্টা, পুলিশের ওপর হামলাসহ অনেকগুলো ধারায় মামলা হচ্ছে। গ্রেপ্তারদের সেসব মামলায় আজই আদালতে পাঠানো হবে।
থানায় থানায় মামলা, আসামি কয়েক হাজার : বুধবারের সংঘর্ষের ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ, পল্টন, মতিঝিল ও শাহজাহানপুরে পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর এসব মামলায় কয়েক হাজার বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) এনামুল হক মিঠু জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় ৪৭৩ জনের নাম উল্লেখ করে পল্টন মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। পুলিশের ওপর হামলা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মামলা হয়েছে। মামলায় ৪৭৩ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত দেড় থেকে দুই হাজার বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, পল্টন ছাড়াও মতিঝিল, শাহজাহানপুর এবং শাহবাগ থানায়ও মামলা হয়েছে।
মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেনÑ বিএনপি চেয়ারপাসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল।
চেকপোস্ট ও তল্লাশি : ১০ ডিসেম্বর বিএনপির গণসমাবেশ কেন্দ্র করে রাজধানীর প্রায় সব প্রবেশমুখ এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা ও গাবতলী এলাকায় দেখা গেছে, ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে পুলিশের তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। কাউকে সন্দেহ হলেই তল্লাশি করা হচ্ছে। গাড়ি থামিয়েও চলছে তল্লাশি।
যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঢাকায় প্রবেশের অংশে (দক্ষিণ অংশ) কামাল ম্যানশনের সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ অবস্থান নিয়েছে। পুলিশের একটি দল পথচারী ও রিকশা আরোহীদের তল্লাশি করছিল। মাঝে মাঝে গাড়ি থামাতেও দেখা যায়।
রাজধানীর গাবতলীতে ও ঢাকার প্রবেশমুখে আমিনবাজার ব্রিজের ওপর পুলিশের বিশেষ চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সেখানে ১৫ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছেন। ঢাকার বাইরে থেকে আসা বাস, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসসহ অন্যান্য পরিবহনও তল্লাশি করে ছাড়া হচ্ছে। তল্লাশির সময় পরিবহনের কাগজপত্রও যাচাই-বাছাই করতে দেখা গেছে। সকাল থেকে সায়েদাবাদ, মতিঝিল, কাকরাইলসহ রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশকে সতর্ক অবস্থানে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, রাজধানীতে নিয়মিত চেকপোস্ট বসছে। কারণ, ১ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চলছে। ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বর এবং ২৫ ডিসেম্বরের মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিন সামনে। এর আগে যেন কোনো ধরনের নাশকতার ঘটনা না ঘটে, সেজন্য আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে চেকপোস্ট বসিয়েছি।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য