নিখিল মানখিন: গত দুই মাস ধরে ডিসেম্বরে খেলা হওয়ার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আর সেই খেলায় এ পর্যন্ত বিএনপিকে পেছনে ফেলে আওয়ামী লীগ এগিয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সমাবেশের ভেন্যু ইস্যুতে পরাজয় হয়েছে বিএনপির। প্রধান কার্যালয়ে বোমা পাওয়ার ঘটনায় হয়েছে কলঙ্কিত।
নতুন করে গ্রেপ্তার ও হামলা-মামলা আতঙ্কে ভুগছেন এবং আশাহত হয়েছেন তৃণমূল বিএনপির নেতাকমীরা। আর রাজধানীতে বিপুল জনসমাগম ঘটাতে দেশবাসীকে দেয়া বিএনপির প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ব্যর্থ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সম্মেলন আয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেশবাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে দলটি।
গত কয়েক মাস ধরে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে ডিসেম্বরে ‘খেলা হবে’। বিএনপিকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখ থেকে বের হওয়া এ হুঁশিয়ারি বার্তার প্রয়োগ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিএনপির আলোচিত গণসমাবেশ।
কিন্তু সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ভেন্যু জটিলতা, সংঘাত, মামলা-হামলা, ধরপাকড়, বিএনপির এমপিদের একযোগে পদত্যাগ সবকিছু নিয়ে লাভ-লোকসানের হিসেব কষতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আন্তর্জাতিক সমর্থনসহ নানাভাবে দেশবাসীর সহানুভ‚তি আদায় করার চেষ্টা করছে বিএনপি। আর আওয়ামী লীগের রাজনীতির জালে ধরা খেয়ে শক্তি পরীক্ষায় বিএনপি পরাজিত হয়েছে বলে প্রশান্তি অনুভব করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় ডিসেম্বরের খেলায় এগিয়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ। রাজধানীতে জনসমাবেশ করার জন্য বর্তমানে সবচেয়ে উত্তম স্থান ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’ বিএনপির সমাবেশের জন্য অনুমতি দিয়ে দেশবাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এর পেছনে ছিল দলটির সূ² রাজনীতি।
ভেন্যু এলাকায় আওয়ামী আবহ বিরাজ করায় এবং এলাকাটি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত না। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যাল এলাকা; বিশেষ করে শাহবাগ মোড় থেকে টিএসসি, দোয়েল চত্বর হয়ে কার্জন হল এলাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিচরণে মুখর থাকে। ফলে সমাবেশে আসা বিএনপি নেতাকর্মীদের মনে অবাধ বিচরণে ভয় কাজ করত।
এছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারদিক সীমানা প্রাচীরবেষ্টিত। কোনো কারণে বিশৃঙ্খলা, অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হলে পালিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হতো। এখানেও জিতেছে আওয়ামী লীগ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরো বলেন, ভেন্যু ছাড়াও নানাভাবে বিএনপির প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে ইতিবাচক আলোচনায় চলে আসে আওয়ামী লীগ। সমাবেশের দিন ঢাকা মহানগর এলাকায় কোনো কর্মসূচি রাখা হয়নি। আর পরিবহন ধর্মঘট না ডাকার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্বিঘেœ সমাবেশ করতে দেয়ার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন দুদিন এগিয়ে আনা হয়।
একইসঙ্গে ৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সম্মেলন শেষ হওয়ার দুদিনের মধ্যেই সম্মেলন মঞ্চ ও প্যান্ডেল সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট নানা ঘটনায় জড়িয়ে বিএনপিকে কলঙ্কিত করার সুয়োগ হয়েছে আওয়ামী লীগের।
রাজধানীর পল্টনে বিএনপির প্রধান কার্যালয়ে বোমাসহ বিভিন্ন বিস্ফোরকদ্রব্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। আর ডিএমপির অনুমতিপ্রাপ্ত একের পর এক ভেন্যু প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি দেশবাসীর সমালোচনার পাত্র হয়েছে। এদিকে বিএনপিকে ঢাকার সম্মেলনে ব্যস্ত রেখে সারা দেশে দলের জেলা ও উপজেলা সম্মেলন ও কমিটি গঠন সম্পন্ন করে চলেছে আওয়ামী লীগ।
দলীয় সূত্র জানায়, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উপজেলা কমিটি সম্পন্ন করে জেলা কমিটিগুলোর সম্মেলন ও কমিটি গঠন এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এতে তৃণমূল কোন্দল সহনীয় পর্যায়ে এনে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কাজ করার পরিবেশ তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগ শিবিরে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ১০ ডিসেম্বর নিয়ে বিএনপি দেশের রাজনীতিতে একটা বিশেষ আগ্রহ তৈরি করতে পেরেছিল। বিশেষ করে ১০ ডিসেম্বরের পর খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশ চলবেÑ এটি আলোচনায় এসেছিল। আবার সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে এমন আলোচনাও ছিল। বাস্তবে এসবের কিছুই হয়নি।
বিএনপির সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলনের বিষয়টি মাথায় রেখে এ মুহূর্তে তিনটি অগ্রাধিকার ঠিক করেছে আওয়ামী লীগ। প্রথমত, দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নির্বাচনমুখী করে ভোটের জন্য প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা জোরদার করা। তৃতীয়ত, সরকার সম্পর্কে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে কিছু নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে ক‚টনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো।
এ বিষয়েও বেশ আশবাদী দলটি। ১০ ডিসেম্বর ঘিরে বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ে অভিযান ও দলটির নেতাদের গ্রেপ্তার। গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহে নিজেদের বড় কোনো লোকসান দেখছে না আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা মনে করছেন, বিএনপির নেতাদের গ্রেপ্তার ও নয়াপল্টনে অভিযান নিয়ে দেশে-বিদেশে কিছু সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু বাধা ছাড়াই শেষ পর্যন্ত দলটিকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে দেয়ায় সে সমালোচনা কিছুটা হলেও কমেছে।
পরক্ষণে আওয়ামী লীগের তৎপরতার কারণে বিপুলসংখ্যক জনসমাগম ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। বিএনপির এমপিদের পদত্যাগও সংসদে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এ প্রসঙ্গে রোববার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপির সংসদ থেকে পদত্যাগ সিন্ধুর মাঝে বিন্দু। এতে সংসদ অচল হবে না।
এ বুদ্ধি যারা দিয়েছেন তারা অচিরেই পস্তাবেন। পতন যখন শুরু হয়, তখন মানুষ ইচ্ছার বাইরেও ভুল করে। বিএনপির সংসদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্তও ভুল বলে জানান ওবায়দুল কাদের।
লাভের বিষয়টি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, গত ১৪ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের শৈথিল্য সৃষ্টি হয়েছিল। দলের ভেতরে দ্ব›দ্ব-সংঘাতও প্রকট। বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ শুরুর পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিভেদ ভুলে রাজপথে সক্রিয় করা গেছে। এটা বড় অর্জন। অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে চাপ দেয়ার পর দলের কর্মীরা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন।
গতকাল সোমবার সকালে চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ১০ ডিসেম্বর সব অচল করে দেয়ার ছক এঁকে বিএনপি এখন নিজেরাই অচল। সরকার পতনের দিবা স্বপ্ন দেখছে বিএনপি। ১০ ডিসেম্বর গেল, শুধু আতঙ্ক সৃষ্টি ছাড়া তারা (বিএনপি) কিছুই করতে পারেনি। ১০ দফা দাবি দিয়েছে, তার মধ্যে নতুন কোনো দাবি নেই। তারা আন্দোলনে হেরেছে। এর মানে নির্বাচনেও হারবে।
বিএনপির সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা হয়ে গেছে; তারা হেরেছে। এরপর সেমিফাইনাল, নির্বাচনে হবে ফাইনাল খেলা। সব খেলায় বিএনপি হারবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এর আগে গত ৯ ডিসেম্বর রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নয়াপল্টন ছেড়ে গোলাপবাগে সমাবেশ করতে রাজি হওয়ায় বিএনপির অর্ধেক পরাজয় হয়েছে। আন্দোলন কর্মসূচি এখানেই অর্ধেক শেষ।
সোমবার আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপির সমাবেশের আগে দলটির নেতারা বলে আসছিল ঢাকা ঘেরাও করবে, সরকারকে ফেলে দেবে, সর্ববৃহৎ সমাবেশ করবে, কোনো কিছুই তো হয়নি। এগুলো সবই ধোঁকাবাজি, মানুষকে শোনানো। বাস্তবতার সঙ্গে তাদের বক্তব্যের কোনো মিল নেই।
রাজনীতির খেলায় বিএনপি কখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে পেরে উঠেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। কারণ আওয়ামী লীগের ক্ষমতার মূল উৎস জনগণ। আর বিএনপি অনেক আগেই জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হয়েছে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য