এম বদি-উজ-জামান: রাজধানীর নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় গত ৭ ডিসেম্বর পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে ছয়মাসের জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তাদের জামিন প্রশ্নে রুল জারি করা হয়েছে।
এদিকে এই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর বলেছেন, হাইকোর্টের জামিন আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন জানানো হবে।
বিচারপতি মো. সেলিম ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার বিএনপির দুই কেন্দ্রীয় নেতার জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। বিএনপি নেতাদের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। এসময় অ্যাডভোকেট এজে মোহাম্মদ আলী, মীর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, ফজলুর রহমান, ব্যারিস্টার এএম মাহবুবউদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সজল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট সগীর হোসেন লিওনসহ শতাধিক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
অপরদিকে জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর। এসময় তারসঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম গোলাম মোস্তফা তারা ও সহকারি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মুহাম্মদ মাজু মিয়া।
দুপুরে হাইকোর্টে জামিন আবেদনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীঅন। তিনি আদালতে বলেন, এই মামলায় এফআইআর-এ নাম থাকা দুই আসামি আমান উল্লাহ আমান ও আব্দুল কাদির ভুইয়া জুয়েলকে সিএমএম আদালত থেকেই জামিন দেয়া হয়েছে। অথচ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসের নাম এফআইআরএ না থাকলেও তাদের জামিন দেয়া হয়নি।
এসময় আদালত বলেন, তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে পুলিশ ফরোয়াডিং-এ কি বলা হয়েছে, পড়–ন। এতেতো বলা হয়েছে, তারা পরিকল্পনাকারী ও উস্কানিদাতা।
জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, এফআইআইরএ যেসব জিনিস জব্দ করার কথা বলা হয়েছে তা এই দুইজনের কাজ থেকে উদ্ধার হয়নি। ঘটনার কথা বলা হয়েছে ৭ ডিসেম্বর। সেদিন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় কার্যালয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাকে ঢুকতে না দেয়ায় তিনি রাস্তায়ই বসে পড়েন। পুলিশ তাকে সেদিন গ্রেপ্তার না করে ৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ৩টায় তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে।
এনিয়ে পুলিশের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, দায়রা জজ আদালত তাদের জামিন না দিয়ে আবেদনটির ওপর আগামী ২৬ জানুয়ারি শুনানির জন্য রেখেছেন। তারা দু’জন সিনির নেতা। সাবেক মন্ত্রী। তারা অসুস্থ। এরপরও দায়রা জজ আদালত দীর্ঘদিন পর শুনানির জন্য রেখেছেন। তাই মানবিক কারণে জামিন আবেদন করা হয়েছে। যেকোনো পর্যায়ে হাইকোর্টেল জামিন দেয়ার এখতিয়ার বা স্বাধীনতা আছে।
এরপর জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর বলেন, এই দুইজনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। ঘটনার দিন বিএনপি কার্যালয়ের ভেতর থেকে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। সেখান থেকে চারহাজার কেজি চাল, নগদ ২ লাখ টাকা উদ্ধার করে পুরিশ সেখান থেকে ককটেল, বাশের লাঠি, ৫ বস্তা ইটপাটকেল জব্দ করা হয়।
তিনি বলেন, বিএনপি কার্যালয় চালান মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সুতরাং সব দায় তার। তিনি বলেন, পুলিশ ফরোয়ার্ডি দেখুন। সেখানে বলা হয়েছে, এই দুইজন ঘটনার পরিকল্পনাকারী, উস্কানীদাতা ও নির্দেশদাতা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জামিন অযোগ্য ধারায়। তিনি বলেন, এই মামলায় যে অভিযোগ তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড ও সর্বনিম্ন শাস্তি ৫ বছরের কারাদন্ড। তাই বিচারের আগে তারা জামিন পেতে পারেন না। তিনি বলেন, মামলায় তদন্ত চলছে। তদন্তের এই পর্যায়ে তাদের জামিন দেয়া হলে তদন্ কার্যক্রম মারাত্মক ব্যাহত হবে।
প্রায় একঘন্টা উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন।
এর আগে গত ২১ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতেও তাঁদের অন্তবর্তীকালীন জামিন আবেদন খারিজ হয়। তবে মূল আবেদনের ওপর ২৬ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করা হয়। এ অবস্থায় হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করা হয়।
এরও আগে গত ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত মূখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন বিএনপির ওই দুই কেন্দ্রীয় নেতার জামিন আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন। এনিয়ে সিএমএম আদালতে ওই দুই নেতার জামিন আবেদন তিনবার খারিজ হলো।
এর আগে গত ৯ ও ১২ ডিসেম্বর ওই দুই নেতার জামিন আবেদন খারিজ করা হয়। এরপর বুধবার(১৪ ডিসেম্বর) সিএমএম আদালতে বিশেষ জামিন আবেদন করা হয়। এই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে তা খারিজ করা হয়েছে।
বিএনপি নেতাদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও মাসুদ আহমেদ তালুকদার। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু।
১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন বিএনপিকর্মী মকবুল হোসেন। সাংবাদিক-পুলিশসহ আহত হন অর্ধশতাধিক। সংঘর্ষের ঘটনায় পল্টন মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা করে। মামলায় ৪৭৩ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত দেড় থেকে দুই হাজার জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা সকলেই বিএনপির নেতাকর্মী।
ওই ঘটনায় সেদিনই নয়াপল্টন থেকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহŸায়ক আমানউল্লাহ আমান, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসসহ সাড়ে চার শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
একই মামলায় ৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাত সোয়া তিনটায় মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে তাদের নিজ নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৯ ডিসেম্বর তাদের ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হলে তাদের জামিন আবেদন খারিজ করে কারাগারে পাঠানো হয়। সেই থেকে তারা কারাবন্দি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য