-->
শিরোনাম
নির্বাচনী প্রস্তুতি

চুলচেরা বিশ্লেষণে আওয়ামী লীগ

নিখিল মানখিন
চুলচেরা বিশ্লেষণে আওয়ামী লীগ

নিখিল মানখিন: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সার্বিক পরিস্থিতির চুলচেরা বিশ্লেষণে নেমেছে আওয়াামী লীগ। দল গোছানোর পাশাপাশি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাত্রা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। এ লক্ষ্যে দলীয় কোন্দল সৃষ্টির কারণগুলা উদ্ঘাটন ও নিরসন এবং শরিক দলগুলো গোছানোর কার্যক্রম চালাচ্ছে দলটি।

 

পাশাপাশি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিটি পদক্ষেপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে আওয়ামী লীগ।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনী বছরে এসে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ওপর বেড়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ। সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি উত্থাপন করে আসছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে চলেছে বিএনপি।

 

এসব চাপের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের দলীয় কোন্দলও আওয়ামী লীগের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলটির সিনিয়র নেতারা বলছেন, দলকে প্রস্তুত করার অংশ হিসেবে একাধিক তৎপরতা এখন চলছে যার মূল উদ্দেশ্য হলো মাঠপর্যায়ে কর্মী ও সমর্থকদের চাঙ্গা করে নির্বাচনের আবহ তৈরি করা। এটি করতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে নেতাদের মধ্যে কোন্দল নিরসনের ওপর।

 

একইসঙ্গে নানা ঘটনায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সে কারণে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের কৌশলও নিয়েছে দলটি। পাশাপাশি প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে ‘চাপ মোকাবিলা’র চেষ্টাও চলছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বেশ কিছুদিন ধরেই আগামী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে নানা ধরনের বিবৃতি দিয়ে আসছে।

 

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা ভোরের আকাশকে বলেন, ঘরে-বাইরে নজর বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় কোন্দল নিরসনের কাজ অব্যাহত রয়েছে। বড় দলে কোন্দল থাকবেই। তবে ক্ষতিকর পর্যায়ে যেতে দেয়া যাবে না। পর্যায়ক্রমে দল এবং তার সহযোগি ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সম্মেলন ও কাউন্সিল অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগে যোগ্য নেতার অভাব নেই। কমিটিতে সবাইকে অনুর্ভুক্ত করার সুযোগও থাকে না।

 

যারা মূল দলের কমিটিতে সুযোগ পাবেন না তাদের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সামনের সারির পদ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। দলীয় সূত্র আরো জানায়, দলে অনুপ্রবেশকারীর বিষয়টি অনেক আগেই নজরে এসেছে। ইউনিয়ন কমিটিতে অনুপ্রবেশকারী রুখে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছে উপজেলা কমিটির নেতাদের ওপর। আর উপজেলা কমিটির প্রার্থীদের বিষয়টি দেখবেন জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।

 

নিজ নিজ পর্যায় থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেই অনুপ্রবেশের সুযোগ থাকবে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ঘরের পাশাপাশি বিরোধী দল এবং বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার সপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে দলে টানার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীদের ১৪ দলীয় জোট।

 

আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের প্রথম ধাপ শেষ করেছে আওয়ামী লীগ। সংসদীয় আসনভিত্তিক জরিপসহ ত্রিমুখী তৎপরতা চলছে। একাধিক সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বিদেশি একটি সংস্থাও জরিপ করছে। সিআরআই তাদের মতো করে তথ্য সংগ্রহ করছে। চলছে সাংগঠনিকভাবে প্রতিবেদন তৈরির কাজ। এসব ক্ষেত্রে সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ব্যাপারে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ সম্পন্ন করে বাছাই কার্যক্রমের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে দলটি।

 

তথ্যগুলো প্রতিবেদন আকারে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হবে। আর দ্বিতীয় ধাপ উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে চ‚ড়ান্ত দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন তিনি। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, দল গোছানোর পাশাপাশি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাত্রা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ।

 

সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের ওপর যে চাপ প্রয়োগ করছে, সেই চাপ নিরসনের জন্য নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। ভারত সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ভারত সফর ও রাশিয়া সফর করেছেন।

 

জেনিভায় জাতিসংঘ মিশনে স্থায়ী প্রতিনিধি, অস্ট্রেলিয়ায় হাই কমিশনার ও ডেনমার্কে রাষ্ট্রদূত পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সরিয়ে দেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে। অক্টোবরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় তিনি দেশের বাইরে ১৮ দিন ছিলেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী।

 

জাতিসংঘের হাই লেভেল মিটিং চলাকালে ৮টি উচ্চপর্যায়ের সভা ও সাইড ইভেন্ট ছাড়াও কয়েকটি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে ১২টি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের বঙ্গবন্ধু হলরুমে সংবাদ সম্মেলনে সাধারণ অধিবেশনে অংশগ্রহণ এবং সফলতার কথা তুলে ধরেন। এভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান সরকারের আমলে দেশের প্রশংসনীয় উন্নয়নচিত্র নানাভাবে আন্তর্জাতিক নেতাদের সামনে তুলে ধরেন।

 

চলতি বছরের গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গুলশানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত এবং ইইউভুক্ত সাতটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের একটি বৈঠক হয়। এতে জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, সুইডেনের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্ব দেন সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। প্রতিনিধি দলে আরো ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ ও কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত।

 

গত ২২ মার্চ ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের আমন্ত্রণে তার বাসায় মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। সেখানে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেন উভয়পক্ষ। গত ৮ এপ্রিল ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি কূটনীতিকদের পাড়ায় পাড়ায় পদচারণা করছে। জাতিসংঘের কাছে নালিশ দেবে বলেছে।

 

জাতিসংঘের কাছে যত নালিশ করেন, যত আবদার করেন, সালিশ করার এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই। বিদেশ থেকে অনেক কূটনীতিক আসে। সরকারের সঙ্গে বৈঠক হয়। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে তারা কোনো বৈঠক করে না। গত ১৭ মার্চ ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করে, আর সে আলোকেই আগামী নির্বাচন করবে। আওয়ামী লীগ এখন নির্বাচনমুখী।

 

সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে দলের মূল কাজটি হলো সঠিক প্রার্থী বাছাই করা এবং সে কাজটিই তারা এখন করছেন। দলের প্রার্থীদের নিয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। দলের কারো কারো বিরুদ্ধে নানা নেতিবাচক খবর এসেছে।

 

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপির হুঙ্কারে কোনো লাভ হবে না। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকারের গঠনের ক্ষমতা জনগণের হাতে। বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন দল। আর জনগণের মাঝে মিশে আছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির অসাংবিধানিক কথাবার্তায় কান দিয়ে আমরা সময় নষ্ট করতে চাই না বলে জানান সুজিত রায় নন্দী।

 

আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, আওয়ামী লীগ এখন পুরোপুরি নির্বাচনমুখী। মাঠের রাজনীতিতে বিএনপিকে ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ। মাঠে আওয়ামী লীগকে টেক্কা দেয়ার মতো দলীয় সামর্থ্য বিএনপির নেই। আওয়ামী লীগের দল গোছানোর কাজ অনেকটা শেষ পর্যায়ে। দলীয় জেলা-উপজেলা সম্মেলন ও কমিটি গঠন শেষ দিকে। সুরাহা হওয়ার শেষ পর্যায়ে তৃণমূল কোন্দলও।

 

জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলছে আলোচনা ও দেনদরবার। জোরালো করা হয়েছে ক‚টনৈতিক যোগাযোগ। গত কয়েক মাসে দলীয় জেলা ও উপজেলা সম্মেলন আয়োজন করে বিশাল বিশাল জনসমাবেশ ঘটিয়ে ইতোমধ্যে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সব মিলিয়ে দলটি এখন নির্বাচনমুখী। দল গোছানোর পাশাপাশি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাত্রা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version