-->
শিরোনাম

শরিকদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় তৎপর বিএনপি

এম. সাইফুল ইসলাম
শরিকদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় তৎপর বিএনপি

এম. সাইফুল ইসলাম: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সমমনা বা শরিকদের সঙ্গে বোঝাপড়া ঠিক রাখতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে বিএনপি। গত এক সপ্তাহে নিজেদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছে বিএনপি। এসব বৈঠকে আগামীর আন্দোলনে কর্মসূচি নির্ধারণ ও জাতীয় নির্বাচন নিয়েও খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে কৌশলী আচরণ এবং সম্পর্কের অবনতি হওয়া কয়েকটি দলের সঙ্গে দূরত্ব কমাতেও কাজ করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে জোর দিচ্ছে দলটি।

 

বিএনপি নেতারা বলছেন, ঈদ-পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে তারা শরিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। আগামীদিনের কর্মসূচির পাশাপাশি অনেক বিষয় নিয়ে এসব বৈঠকে খোলামেলা আলোচনা স্থান পাচ্ছে। এছাড়া দাবি আদায়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমর্থন বা কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়টি তারা স্বীকার করছেন।

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো বাকি প্রায় নয় মাস। তারপরও দেশের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নানা মেরুকরণ। আওয়ামী লীগ সংবিধানের কথা বলে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে অনড়। আর বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করার দাবিতে এখন আন্দোলনে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপি রমজানেও রাজপথে। বিএনপির সঙ্গে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ যুগপৎভাবে কর্মসূচিতে মাঠে রয়েছে। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপিসহ কয়েকটি দল ও সংগঠন বিএনপির ১০ দফা দাবির প্রতি সমর্থনে কর্মসূচি পালন করছে। যদিও বিএনপির ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ থেকে দেয়া ১০ দফার প্রতি জামায়াত সমর্থন জানালেও গত কয়েক মাসের কর্মসূচিতে তারা যুগপৎ আন্দোলনে নেই।

 

বিএনপি এখন শরিকদের সঙ্গে যে বোঝাপড়ায় ব্যস্ত, তা গত কয়েকদিনের কর্মতৎপরতায় স্পষ্ট। গত ২ এপ্রিল গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলটির নেতারা গণতন্ত্র মঞ্চের লিয়াজাঁ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। ৭ এপ্রিল ১২ দলীয় জোটের লিয়াজোঁ কমিটি ও বিএনপি নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গত ৮ এপ্রিল জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। এসব বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। জোটগুলোর দায়িত্বশীল নেতারা অংশ নেন বৈঠকে। বৈঠকে অংশ নেয়া একাধিক নেতা ভোরের আকাশকে জানিয়েছেন, ঈদ-পরবর্তী কর্মসূচি ও আন্দোলনের নানা কৌশল নিয়ে এসব বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। নিজেদের মধ্যে মান-অভিমান নিয়েও পরস্পরের আলোচনায় উঠে আসে। এছাড়া অবশিষ্ট দল ও সংগঠনের সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে বৈঠক হবে বলে জানা গেছে।

 

গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক ও সমন্বয়ের চেষ্টা করছে বিএনপি। সম্প্রতি বৈঠকে আগামীর কর্মসূচি, কৌশল নির্ধারণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাপার (জাফর) নেতা মোস্তফা জামাল হায়দার বলেছেন, কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার পটাশাপাশি একসঙ্গে চলতে গেলে অনেক সময় ভুল বুঝাবুঝি হয়, সেগুলো যেন না হয় সে ব্যাপারেও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।

 

এদিকে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে বেশ কৌশলী বিএনপি। ওই নির্বাচনের পর থেকে জামায়াতকে বিএনপির কর্মসূচিতে দেখা যায়নি বললেই চলে। একদিকে ইসলামী দল আর অন্যদিকে বাম দলগুলোকে নিয়ে ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গড়তে অনেকে জামায়াতকে বাধা হিসেবে দেখে। এছাড়া দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে নেতিবাচক ধারণা থাকায় জামায়াতকে কৌশলে দূরে রাখে বিএনপি। তবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণার পর জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তারের পর অনেকেই বলছেন, বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে কৌশলী ভূমিকা পালন করছে। বিষয়টি নিয়ে জামায়াতের নেতারাও বেশ কৌশলী কথা বলেন। সভা-সমাবেশে যাই বলুক না কেন, আন্দোলন আর ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত যেন হাতছাড়া না হয়, সে বিষয়ে বিএনপি নেতারা কাজ করছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। জামায়াত নেতাদের কথায়ও তার আভাস মেলে।

 

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আজীজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, ‘জোটবদ্ধ ও যৌথভাবে’ এক জিনিস নয়। আগে একত্রে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। আর এখন নেতৃত্বে থাকা বিএনপির দেয়া কর্মসূচি পালন করছে সমমনারা। জামায়াতও যুগপৎ অনেক কর্মসূচি একসঙ্গে পালন করছে। আবার পৃথকভাবেও কর্মসূচি পালন করছি আমরা। তিনি বলেন, জামায়াত চায় দেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। যার মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। বিএনপিও সেটিই চায়। অর্থাৎ মৌলিক দাবি কিন্তু একই।

 

জানা গেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনের এখনো নয় মাস বাকি থাকলেও বিএনপি কূটনৈতিক সমর্থনে জোরালোভাবে কাজ করছে। বিশে^র প্রভাবশালী কয়েকটি দেশকে টার্গেট করে এগোচ্ছে বিএনপি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি ভারত, চীনকে টার্গেট করে কাজ করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। গোটা পশ্চিমা বিশ^ এখন বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রকৃত অর্থে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে সোচ্চার। তারা বাংলাদেশে নির্বিঘ্নে মতপ্রকাশ ও মানবাধিকার নিয়েও কথা বলে আসছেন। গত দুই সংসদ নির্বাচনের ত্রুটি নিয়েও তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে কথা বলছেন। সবশেষ সোমবার ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে যাতে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সারাবিশ্ব তাকিয়ে আছে। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন এ অঞ্চল এবং সারাবিশ্বের জন্য একটি জোরালো উদাহরণ তৈরি করতে পারে।

 

কূটনীতিকদের কাছে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগে কাজ করছেন বিএনপি নেতারা। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন, কর্মসূচি পালনে সরকারের কঠোরতা ও মানবাধিবকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে তুলে ধরছেন বিএনপি নেতারা।

 

গত ৩১ মার্চ ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের নিয়ে জমকালো ইফতার পার্টি করে বিএনপি। এতে ২২টি দেশের কূটনীতিকরা অংশগ্রহণ করেন। এর আগে গত ১২ মার্চ বিএনপির একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) আটটি দেশের কূটনীতিকদের বৈঠক হয়। ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির বাসায় ওই বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকে আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ স্থান পায়। কেন এ সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যেতে চায় না, সেটিও রাষ্ট্রদূতদের পরিষ্কার করেন দলটির প্রতিনিধিরা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ এবং মানবাধিকার সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ ওই বৈঠকে অংশ নেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকের পর গত ১৬ মার্চ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার আমন্ত্রণে তার বাসায় নৈশভোজে অংশ নেন। ওই বৈঠকে আগামী নির্বাচন ও চলমান আন্দোলন নিয়ে কথা হয়।

 

এর আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বিএনপি নেতারা বৈঠক করেন। অর্থাৎ বিএনপির জোর কূটনৈতিক তৎপরতা এখন দৃশ্যমান। এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে ঈদের পর ধারাবাহিতকার অংশ হিসেবে বিএনপি কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো বাড়াবে বলে জানা গেছে। ঈদের পরপরই বিএনপির ৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল ভারত সফরে যাবে বলে ইতিমধ্যে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিএনপি জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে গত ১৮ মার্চ দৈনিক ভোরের আকাশে ‘ভারতকে আস্থায় আনতে তৎপর বিএনপি’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

 

 

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে- দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের সুরক্ষায় জাতিসংঘকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাবে দলটি। সরকার আবারো ‘পাতানো নির্বাচন’ আয়োজন করতে চায় বলেও জাতিসংঘে জানাবে বিএনপি। জাতিসংঘের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), কমনওয়েলথকেও একই বিষয়ে চিঠি দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া ঈদ-পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ের কৌশলে বিএনপি নেতারা ঈদের পরপরই কূটনীতিকদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করতে ইতোমধ্যে তোড়জোড় শুরু করেছেন।

 

বিএনপির আরো একটি সূত্র বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে পশ্চিমা ও তাদের মিত্র দেশগুলো তৎপরতা বাড়িয়েছে। তাদের আস্থায় আনার তৎপরতার অংশ হিসেবে আগামী ২৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফর করবেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর করবেন বলেও প্রকাশিত খবরে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে বিএনপি।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিদেশবিষয়ক কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেছেন, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফেরাতে জনগণের সমর্থনই বড় শক্তি। ঈদ-পরবর্তী কর্মসূচি, কৌশলসহ নানা বিষয় নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গে তারা বৈঠক করছেন। জামায়াতের বিষয়ে তিনি বলেন, নির্দিষ্ট একটা দল বড় বিষয় নয়, যারা এ সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে বিএনপি তাদের সাধুবাদ জানাচ্ছে।

 

আর কূটনৈতিক তৎপরতার বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখন সংকটে। দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবেশও নেই। গণতন্ত্র ফেরাতে বিশে^র গণতন্ত্রমনা দেশগুলোর একটা ভূমিকা থাকে। আমরা সেটিও কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। সরকার যে মিথ্যা তথ্য বিভিন্ন স্থানে দেয় আমরা প্রকৃত সত্যটা জানানোর চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে এই সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, সেটিও জানাচ্ছে বিএনপি। সেখানে দেশের গণতন্ত্রহীনতা, গত দুই নির্বাচনে ভোটের নামে প্রহসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি উঠে আসবেÑ এটা খুব স্বাভাবিক।

 

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান ভোরের আকাশকে বলেছেন, বর্তমান সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি আর ভোট চুরির বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করছে, তাদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। এসব বৈঠকে অনেক বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। মাঝে মাঝে বৈঠক করলে দূরত্ব বা ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয় না।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version