-->
শিরোনাম

জামায়াতের কৌশলী ভূমিকায় নানা প্রশ্ন

এম সাইফুল ইসলাম
জামায়াতের কৌশলী ভূমিকায় নানা প্রশ্ন

এম সাইফুল ইসলাম: দেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ‘কৌশলী অবস্থান’ এখন বেশ আলোচনায়। দীর্ঘদিনের সঙ্গী বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন থেকে সরে এখন অনেকটাই ‘একলা চলো’ নীতিতে চলছে জামায়াত। ফলে প্রশ্ন উঠেছেÑ জামায়াতের একলা চলো নীতি কৌশলগত অবস্থান নাকি সরকারের সঙ্গে আপসের ইঙ্গিত। জামায়াতের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনের এখনো ৮ মাসের বেশি সময় বাকি থাকায় দলটির নেতারা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত রয়েছেন।

 

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে তৎপর রয়েছেন তারা। তবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে তৎপর না থাকার বিষয়ে তারা ‘কৌশলী’ বক্তব্য দিচ্ছেন। তারা বলছেন, যুগপৎ কর্মসূচির বাইরেও তারা দলীয় নিজস্ব নানা কর্মসূচি পালন করছেন। আর সরকারের সঙ্গে আপসের আলোচনাকে তারা গুজব হিসেবে দেখছেন। জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। যদিও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটা সময় ওই জোট থেকে বের হয়ে যান। এরপর ২০০১ সালে জোটবদ্ধ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসে। আদর্শগত নানা বিরোধ থাকলেও টিকে ছিল বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক। জোট সরকারের ক্ষমতার শেষ হওয়ার পর প্রায় ২ বছর ১/১১ সরকারের সময় পার করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও জোটগতভাবে ভোট করে বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের কাছে বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়।

 

জানা গেছে, ২০০৮ সালে জয়লাভ করে সরকার গঠনের পর মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি করে আওয়ামী লীগ। ওই বিচারে ইতোমধ্যে জামায়াতের জ্যেষ্ঠ ৯ নেতার বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করা হয়েছে। ২০১৩ সালের আগস্টে দেশের সর্বোচ্চ আদালত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে রায় প্রদান করেন। এরপর থেকে জামায়াত তাদের নিজস্ব প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ মার্কা নিয়ে ভোট করার ক্ষমতাও হারিয়েছে। এরপর নেতাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা ও তা কার্যকর করা এবং ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকানো ইস্যুতে জ¦ালাও-পোড়াও আন্দোলনের অভিযোগ রয়েছে দলটির বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় অসংখ্য মামলার ঘানি টানছেন দলটির নেতাকর্মীরা। ওই সময়কার আন্দোলনে বিএনপিকে খুব একটা পাশে পায়নি জামায়াত। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জামায়াত নিজেদের মাঠের রাজনীতিতে অনেকটাই গুটিয়ে নেয়। এরপর জামায়াতের তৃণমূল ব্যস্ত ‘দাওয়াতি’ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পরাজিত হওয়ার পর আরো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে জামায়াত। পরে দলটি বিভিন্ন সেক্টরে দক্ষ লোকবল সৃষ্টির মিশনে মাঠে নামে।

 

নানা অবিশ্বাস ও মান-অভিমানে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ২০ দলীয় জোটও অকার্যকর হয়ে পড়ে। বিএনপিও অনেকটাই ‘একলা চলো’ নীতিতে এগোতে থাকে। জোটসঙ্গী জামায়াতের ব্যাপারে ‘কৌশলী’ বিএনপি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে ‘বৃহৎ ঐক্য’ গড়তে তৎপর হয়। এরই মাঝে গত বছরের ২৭ আগস্ট জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বিএনপি জোট ছাড়ার ঘোষণার ভিডিও ব্যাপক ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওতে তিনি বলেন, ‘আমরা এতদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম। তবে বছরের পর বছর পর এ ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে তাদের যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করব আমরা’। যদিও এর কয়েকদিন পর গত ৯ ডিসেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জোটের এক সভায় রাজনৈতিক কৌশলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কার্যত ভেঙে দেয়া হয়। পরে গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠের জনসভায় ১০ দফা দাবি আদায়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ওইদিন বিকেলেই জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান বিএনপির কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বক্তব্য দেন। এরপর গণতন্ত্র মঞ্চ, ১১ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ কয়েকটি দল নিজস্বভাবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন।

 

প্রথম দিকে বিএনপির যুগপৎ কর্মসূচিতে মাঠে ছিল জামায়াত। যুগপৎ কর্মসূচির প্রথমেই ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিল পালনকালে রাজধানীর মৌচাকে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশ ও জামায়াতের কয়েকজন আহত হন। গ্রেপ্তার করা হয় দলটির কয়েকজন কর্মীকে। ওই ঘটনায় বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি দেয়া বা খোঁজখবর না নেয়ায় জামায়াত আবারো মনঃক্ষুণ্ন হয়। নতুন করে ভাবতে শুরু করে জামায়াত। পরে যুগপৎ আর কোনো কর্মসূচিতে সরাসরি অংশ নেয়নি দলটি।

 

জানা গেছে, বর্তমানে বিএনপি নিজস্ব সিদ্ধান্তে কর্মসূচি ঠিক করে শরিকদের জানিয়ে দেয়। সেখানেও আপত্তি আছে জামায়াতের। দলটির নেতারা মনে করেন, কর্মসূচি ঠিক করার আগে অন্তত সমমনা বা শরিকদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত বিএনপির। তাই জামায়াত এখন বিএনপির সঙ্গে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে নতুন করে মামলা ও কর্মীদের শক্তি ক্ষয় করতে চায় না। জামায়াতে ইসলামী দেখতে চায় আসলে বিএনপির আন্দোলন কোনদিকে যায়। টিকে থাকার মতো পর্যায় বা সরকারকে চ্যালেঞ্জের মতো কোনো আন্দোলন করতে পারলে বা সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে অবশ্যই সেই আন্দোলনে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামতে চায় জামায়াতে। আর বিএনপি সঠিক পন্থায় আন্দোলন করতে না পারলে অতীতে; বিশেষ করে ২০১৩-১৪ সালের মতো মাঠে নেমে নতুন করে ক্ষতির শিকার হতে চান না দলটির নেতাকর্মীরা।

 

দলটির তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব মনোভাবের সত্যতাও পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিয়ে যশোর জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য ও শিক্ষা, সহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ফজলুল হকের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনেও মাঠে আছে জামায়াত। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচির পাশাপাশি স্বতন্ত্র কর্মসূচিও পালন করা হচ্ছে। তবে নানা কারণে এখনো দলের নেতাকর্মীরা সিরিয়াসলি মাঠে নামেনি।

 

সাবেক এ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমান সরকারের সঙ্গে আপস করে তাদের অধীনে ভোটে গিয়ে কোনো লাভ হবে না- এটি নেতাদের মাথায় আছে। এখনো সময় আছে। দল সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। রাজধানীর রমনা থানা জামায়াতের সেক্রেটারি আতিকুর রহমান বলেন, দলীয় অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড নিয়ে আমরা এখন ব্যস্ত রয়েছি। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে কর্মীরা মাঠে আছে ও থাকবে।

 

বেশিরভাগ যুগপৎ কর্মসূচিতে মাঠে অনুপস্থিত কেন- এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু করি না। সাতক্ষীরা জেলার জামায়াতের নেতা ও সাবেক এক জনপ্রতিনিধি বলেন, অতীতে কঠিন সময়ে জামায়াত মাঠে থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে। অনেক কর্মী প্রাণ দিয়েছেন। হামলা মামলার শিকার হয়েছেন। এবার বিএনপি কী করে, আগে তা দেখেশুনে আমরা মাঠে নামতে চাই।

 

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আজিজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, আগে কর্মসূচি পালন করা হতো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে। আর এখন হচ্ছে যৌথভাবে। ‘জোটবদ্ধ ও যৌথভাবে’ এক জিনিস নয়। জামায়াত যুগপৎ অনেক কর্মসূচি একসঙ্গে পালন করছে। আবার পৃথকভাবেও কর্মসূচি পালন করছি আমরা।

 

তিনি বলেন, কর্মীদের মাঝে অতীতেত নানা অভিজ্ঞতা আছে। তবে বৃহৎ স্বার্থে তা সামনে আনা সমীচীন নয়। দল যখন সিদ্ধান্ত নেবে, তখন সবাই মাঠে নামবে। ভোটাধিকারের আন্দোলনে জামায়াত মাঠে ছিল, আগামীতেও থাকবে। আর জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, জামায়াতে ইসলামী একটি সুসংগঠিত সংগঠন। সব নেতাকর্মী দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে চলে। আমরা আন্দোলনে আছি। তবে শুরুর দিকে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে মাঠে নামলেও এখন জামায়াতের অনুপস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, দল হিসেবে জামায়াতের একটি স্বাতন্ত্র্যবোধ আছে। তাই অনেক ক্ষেত্রে আমরা নিজস্ব কায়দায় প্রোগ্রাম করছি। আর সরকারের সঙ্গে আপসের বিষয়টিকে তিনি কতিপয় ব্যক্তির অপপ্রচার ও গুজব হিসেবে দেখছেন।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version