-->
শিরোনাম
হত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ

প্রতিহিংসার হত্যার শিকার লক্ষ্মীপুরে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা

মোতাহার হোসেন
প্রতিহিংসার হত্যার শিকার লক্ষ্মীপুরে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা

মোতাহার হোসেন: রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় হত্যাকাণ্ডের শিকার লক্ষ্মীপুর জেলার বশিকপুর ইউনিয়নে যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম। গত ২৫ এপ্রিল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টা থেকে পৌনে ১০টার দিকে বশিকপুর ইউনিয়নে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ মামলায় গতকাল শনিবার পর্যন্ত মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত জেহাদী এখনো পলাতক। তাকে ধরতে পুলিশের একাধিক টিম অভিযান অব্যাহত রেখেছে।

 

র‌্যাব জানায়, মামলার প্রধান অভিযুক্ত আবুল কাশেম জিহাদী ২০২১ সালে বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন। নিহত আব্দুল্লাহ আল নোমান লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই। নোমানের সাংগঠনিক দক্ষতার কারণেই তার ভাই মাহফুজুর রহমান বশিকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে জয়লাভ করেছেন।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উক্ত নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর থেকে আবুল কাশেম জেহাদী বর্তমান চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান ও তার ছোট ভাইয়ের উপর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। এরই জের হিসেবে আবুল কাশেম জিহাদীর মদদে কতিপয় সন্ত্রাসী পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এই ডাবল হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত প্রধান আসামি আবুল কাশেম জিহাদী ১৯৯৬ সালে বশিকপুরে জেহাদী বাহিনী গড়ে তোলে। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৩০০ জন।

 

এই বাহিনীর মাধ্যমে এলাকায় অধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, বাড়ি দখলসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে সে। ২০১৩ সালে পার্শ্ববর্তী দত্তপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূর হোসেন শামীম হত্যা মামলা, ২০০০ সালে লক্ষ্মীপুরে আইনজীবী নূরুল ইসলাম, দত্তপাড়া এলাকার আবু তাহের, বশিকপুর নন্দিগ্রামের মোরশেদ আলম, করপাড়ার মনির হোসেন, উত্তর জয়পুরের সেলিম ভূঁইয়া ও কামাল হোসেন হত্যাসহ অনেক হত্যা মামলার সে আসামি। তার কিলার বাহিনীর হাতে সর্বশেষ সংঘটিত হয় বশিকপুরে ডাবল মার্ডার। র‌্যাব-১১ লে. কমান্ডার মাহমুদুল হাসান এসব তথ্য জানিয়েছেন।

 

র‌্যাব জানায়, চাঞ্চল্যকর এই ডাবল মার্ডারের র‌্যাব-১১ গোয়েন্দা টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে র‌্যাবের গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যহত আছে। হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলের সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আটজনের একটি দলকে প্রাথমিকভাবে ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে শনাক্ত করেছে।

 

গোয়েন্দা কার্যক্রম ও আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখাসহ র‌্যাবের বিশেষ টিম ঢাকা ও লক্ষ্মীপুরের বশিকপুরে অভিযান চালিয়ে মামলার তিনজন এজাহার নামীয় আসামিসহ মোট ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। র‌্যাব কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানিয়েছেন।

 

গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- মশিউর রহমান নিশান, দেওয়ান ফয়সাল, রুবেল দেওয়ান ও নাজমুল হোসেন। তাদের বিরুদ্ধে আগেও একাধিক মামলা রয়েছে। এর আগে জেলা পুলিশ আরো ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে। জোড়া খুনের ঘটনায় এ নিয়ে মোট ১০জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

 

বশিকপুর ইউনিয়ের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, তারা এখনো জেহাদী আতঙ্কে আছেন। জেহাদী কাশেম এক সময় এলাকার ছিটকে চোর ছিল। পরবর্তীতে সে আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সক্রিয় সদস্য হিসেবে এলাকায় ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৫ সালে কাশেম জেহাদী একবার গ্রেপ্তার হয়েছে। এরপর জামিনে ছাড়া পেয়ে পরে সৌদি আরবে চলে যায়। ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে জামায়াতে ইসলামীর ছত্রছায়ায় এলাকায় ওয়াজ মাহফিল করতে থাকে। তার ওয়াজ শুনে বশিকপুর ইউনিয়নের রশিদপুরে একটি মাদরাসা মাঠে স্থানীয় একজন মাওলানা তাকে জেহাদী কাশেম হিসেবে খেতাব পায়।

 

এরপর এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী আবুল বাসারের পক্ষ নিয়ে সে কাজ করে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় এলাকায় রকেট লাঞ্চালের আদলে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে প্রথম মাঠে নামে। পৌদ্দার বাজার ইউনিয়ন অফিসে হামলা, ভাঙচুর, ইউনিয়নের একজন দফাদারকে গুলি করে। পরবর্তীতে মামলা জড়ানোর পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকেন। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এলাকায় বাঁচতে আওয়ামী লীগে যোগদান করে। এরপর তার জেহাদী বাহিনী গঠন করে। তার বাহিনীর হাতে পোদ্দার বাজারে বাবুলকে পিটিয়ে হত্যা,সংখ্যালঘু বাড়ি দখলসহ কমপক্ষে ২৪ জনকে হত্যা করেছে বলে এলাবাসীর অভিযোগ।

 

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হত্যাকাণ্ডের দিন সকাল থেকে ঘটনার আগ পর্যন্ত জেহাদী বাহিনীর প্রায় একশ ক্যাডার পোদ্দার বাজারে ছিল। আর ৪টি গ্রুপ ভাগ হয়ে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। দলীয় বিরোধ, নির্বাচনের আগে কোন্দল মিটিয়ে সবাই একসঙ্গে কাজ করার জন্য বৈঠকে বসার কথা বলে তার বডিগার্ডকে দিয়ে নোমানকে টেলিফোন করেছে বলে স্থানীয়রা জানায়। তারা বশিকপুর পোদ্দার বাজার থেকে বের হওয়ার পরও পরিকল্পনা মতে বাহিনীর ৮ সদস্যের ক্যাডারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। এক গ্রুপ ব্যর্থ হলে অন্য গ্রুপ কিলিং মিশনে অংশ নেবেন এমন অবস্থায় করছিল।

 

স্থানীয়দের অভিযোগ, ঘটনার সময় কাশেম জিহাদী মুখোশ পরে উপস্থিত ছিল। সে অন্যের মোবাইল সিম ব্যবহার করেছে। ঘটনার সময়ের স্থানীয় একটি মাদরাসার সামনে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ থেকে একটি সংস্থা ভিডিও সংগ্রহ করেছেন। ওই মাদরাসার ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামিদেরকে সহজেই শনাক্ত করা হয়েছে।

 

পোদ্দার বাজার, ঢাকার নয়াবাজার ও বংশাল এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বশিকপুর ইউনিয়নে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, সংখ্যালঘুদের বাড়ি দখল, লাদেন গ্রুপের লাদেনকে হত্যা, ঢাকার ব্যবসায়ীদেরকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পুলিশে দেয়ার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়সহ নানা অপরাধ জেদাহী কাশেম জড়িত। জেহাদী বাহিনীর এখনো অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। তার বাহিনীর কাছে কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০টি আগ্নেয়াস্ত্র আছে বলে ধারনা করছেন। রাজধানীর সদরঘাট এলাকার তার এক গডফাদার তাকে ’৯৮ সালে একটি কারা রাইফেল কিনে দিয়েছেন এমন তথ্য এলাকাবাসীর মুখে মুখে।

 

এদিকে আলোচিত এ ডাবল মার্ডারের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় বাদী মাহফুজুর রহমান এজাহারে লিখিত অভিযোগে জেহাদী কাশেমকে এক নম্বর আসামি করে মোট ১৮ জনকে অভিযুক্ত করেছেন। অজ্ঞাত আরো ১৪ থেকে ১৫ জন আছে বলে উল্লেখ করেছে। ঘটনার সময় হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২৫ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টা থেতে পৌনে ১০টা। ঘটনাস্থল হলো বশিকপুর পৌদ্দার বাজার থেকে নাগেরহাটে যাওয়ার পথে নন্দীগ্রাম আনোয়ারের স-মিলের সামনের রাস্তা। অভিযোগ রয়েছে, জেহাদী কাশেম রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ছিটকে চোর থেকে বেপরোয়া হয়ে উঠে এলাকায় সন্ত্রাস করত। তার দাপটে পুরো বশিকপুর ইউনিয়নের নারী-পুরুষ ছিল তটস্থ। অনেকে বাসাবাড়িতে যেতে ভয় পেত। সন্ধ্যার পরে তার বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করত। লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা হত্যা মামলায় আরো ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জোড়া খুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ১০ জন।

 

চন্দ্রগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ওই ঘটনায় নতুন করে ছয়জন গ্রেপ্তার হয়েছে। এর মধ্যে র‌্যাব চারজনকে ও পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলো- বশিকপুর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মশিউর রহমান, রামগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক দেওয়ান ফয়সাল, আওয়ামী লীগ কর্মী রুবেল দেওয়ান ও নাজমুল হোসেন। এর মধ্যে মশিউর মামলার দ্বিতীয়, ফয়সাল তৃতীয় ও রুবেল ১১ নম্বর আসামি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে নাজমুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ফারুক হোসেন ও আরমান হোসেন নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

 

ভোরের আকাশ/আসা

 

মন্তব্য

Beta version