নিখিল মানখিন: এক দফা আন্দোলন বাস্তবায়নের কর্মসূচি তৈরি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে বিএনপি। দাবি আদায়ের আন্দোলনের নকশা তৈরিতে কূলকিনারা পাচ্ছে না বিএনপি। কঠোর আন্দোলনের হুঙ্কার দিয়েও মাঠে শক্ত অবস্থানে নেই তারা। ফলে মাঠপর্যায়ে দলটির নেতাকর্মীরা জোরালো আন্দোলনের তাগিদ দিচ্ছেন।
অন্যদিকে, বিএনপিকে আন্দোলনের ঘোরে ফেলে দিয়ে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ। সভানেত্রীর নির্দেশনা পেয়ে জনগণের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। দলীয় মনোনয়ন বাছাইয়ের কাজও এগিয়েছে অনেক দূর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, বিএনপির বাগযুদ্ধ, মাঠযুদ্ধ এবং বিদেশি কূটনৈতিক তৎপরতা কোনোটাই আমলে নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। কঠোর ও চূড়ান্ত আন্দোলনের দিন-তারিখ ঘোষণা দিতে সময় নিচ্ছে বিএনপি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায় প্রতিদিন কথায় কথায় কঠোর আন্দোলনের বিষয়টি জোরেশোরে জানালেও কর্মসূচি তৈরি করতে গিয়ে আটকে যাচ্ছেন বিএনপি নেতারা।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আওয়ামী লীগকে চাপে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে বিএনপি। নির্বাচনের আগেই নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছে তারা। সরকার পতন ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে এক দফা আন্দোলন করার পরিকল্পনা করছে দলটি। এজন্য আগে থেকে পর্যায়ক্রমে কর্মসূচি পালন করে আসছে তারা। একই ধরনের কর্মসূচিতে আছে সমমনা আরো অনেক দল।
এসব দলকে নিয়ে চলমান যুগপৎ আন্দোলনকে এক দফার আন্দোলনে পরিণত করে দাবি আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির।
দলটির বিভিন্ন সূত্রের দাবি, এক দফার আন্দোলন সফল করতে এখন পর্যায়ক্রমে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এক দফার আন্দোলন হবে চ‚ড়ান্ত আন্দোলন। এতে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।
মঙ্গলবার দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সারা দেশের মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। সময় থাকতেই জনগণের মনোভাব বুঝে বিএনপি ঘোষিত ১০ দফা মেনে নিয়ে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহব্বান জানাচ্ছি। অন্যথায় রাজপথে জনগণের দাবির ফয়সালা করা হবে।
তিনি আরো বলেন, এই অবৈধ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে না। জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। সংসদ ভেঙে দিয়ে এই অবৈধ সরকার পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি আজ গণদাবিতে পরিণত হয়েছে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।
এদিকে, বসে নেই আওয়ামী লীগ। জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজ নিজ এলাকায় দলীয় মনোনয়ন পেতে দলীয় হাইকমান্ডের নজরে পড়তে নানা উপায়ে শোডাউন করে যাচ্ছেন দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীরা। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় জেলা ও বিভাগীয় নেতাদের নিয়ে দফায় দফায় সভা করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড।
দল গোছানোর পাশাপাশি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাত্রা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। এ লক্ষ্যে দলীয় কোন্দল সৃষ্টির কারণসমূহ উদ্ঘাটন ও নিরসন এবং শরিক দলগুলো গোছানোর কার্যক্রম চালাচ্ছে দলটি।
পাশাপাশি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিটি পদক্ষেপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলছেন, দলকে প্রস্তুত করার অংশ হিসেবে একাধিক তৎপরতা এখন চলছে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো মাঠ পর্যায়ে কর্মী ও সমর্থকদের চাঙ্গা করে নির্বাচনের আবহ তৈরি করা। এটি করতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে নেতাদের মধ্যে কোন্দল নিরসনের ওপর। একই সঙ্গে নানা ঘটনায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
সে কারণে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের কৌশলও নিয়েছে দলটি। পাশাপাশি প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে ‘চাপ মোকাবিলা’র চেষ্টাও চলছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা ভোরের আকাশকে বলেন, ঘরে-বাইরে নজর বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় কোন্দল নিরসনের কাজ অব্যাহত রয়েছে। বড় দলে কোন্দল থাকবেই। তবে ক্ষতিকর পর্যায়ে যেতে দেয়া যাবে না। পর্যায়ক্রমে দল এবং তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সম্মেলন ও কাউন্সিল অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগে যোগ্য নেতার অভাব নেই। কমিটিতে সকলকে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগও থাকে না।
যারা মূল দলের কমিটিতে সুযোগ পাবেন না, তাদের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সামনের সারির পদ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
দলীয় সূত্র আরো জানায়, দলে অনুপ্রবেশকারীর বিষয়টি অনেক আগেই নজরে এসেছে। ইউনিয়ন কমিটিতে অনুপ্রবেশকারী রুখে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছে উপজেলা কমিটির নেতাদের ওপর। আর উপজেলা কমিটির প্রার্থীদের বিষয়টি দেখবেন জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। নিজ নিজ পর্যায় থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেই অনুপ্রবেশের সুযোগ থাকবে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা।
ঘরের পাশাপাশি বিরোধী দল এবং বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার স্বপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে দলে টানার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীদের ১৪ দলীয় জোট।
আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের প্রথম ধাপ শেষ করেছে আওয়ামী লীগ। সংসদীয় আসনভিত্তিক জরিপসহ ত্রিমুখী তৎপরতা চলছে। একাধিক সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বিদেশি একটি সংস্থাও জরিপ করছে। সিআরআই তাদের মতো করে তথ্য সংগ্রহ করছে। চলছে সাংগঠনিকভাবে প্রতিবেদন তৈরির কাজ। এসব ক্ষেত্রে সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ব্যাপারে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ সম্পন্ন করে বাছাই কার্যক্রমের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে দলটি। তথ্যসমূহ প্রতিবেদন আকারে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হবে। আর দ্বিতীয় ধাপ উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে চ‚ড়ান্ত দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন তিনি।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ এখন নির্বাচনমুখী। আওয়ামী লীগ সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করে, আর সে আলোকেই আগামী নির্বাচন করবে। সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান ভোরের আকাশকে বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের মূল কাজটি হলো সঠিক প্রার্থী বাছাই করা এবং সে কাজটিই তারা এখন করছেন। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের বিকল্প নেই। দলটির নির্বাচনকেন্দ্রিক কার্যক্রম অনেক আগেই শুরু হয়েছে বলে জানান মুহাম্মদ ফারুক খান।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ভোরের আকাশকে বলেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি চলছে। সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে দলটি। বিএনপির অসাংবিধানিক কথাবার্তায় কান দিয়ে লাভ নেই। দেশে ইতোমধ্যে জাতীয় নির্বাচনের আবহ তৈরি হতে শুরু করেছে। জনগণ তাকিয়ে আছে নির্বাচনের দিকে।
পরবর্তী সরকার নির্ধারণের ক্ষমতা তাদের হাতেই।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য