-->

এবারো আন্দোলনে জামায়াতকে পাশে পাবে বিএনপি!

এম সাইফুল ইসলাম
এবারো আন্দোলনে জামায়াতকে পাশে পাবে বিএনপি!

এম সাইফুল ইসলামঃ সরকার পতন ও তত্ত্বাবধয়াক সরকারের দাবিতে রাজপথে থাকা বিএনপি এবারো আন্দোলনের মাঠে পাশে পাচ্ছে দীর্ঘদিনের সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীকে। বিএনপি শক্তভাবে মাঠে থাকলেই শুধু জামায়াতকে পাশে পাবে দলটি। আর বিএনপি যদি শক্তভাবে মাঠে না থাকে, সেক্ষেত্রে আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গী হবে না জামায়াত। এদিকে নানা কারণে জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব নিরসনে দল দুটির নেতাদের মাঝে আলাপ-আলোচনাও চলছে বলে জানা গেছে।

 

জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতারা বলছেন, বিএনপির আন্দোলনে জামায়াতকে পাশে পেতে হলে যুগপৎ আন্দোলনের পদ্ধতিগত পরিবর্তন করতে হবে। কর্মসূচি গ্রহণের পর সিদ্ধান্ত না জানিয়ে অবশ্যই আগে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার তাগিদ তাদের। মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার অভিন্ন লক্ষ্য দল দুটির। তাই সার্বিক ‘বোঝাপড়া’ ঠিক থাকলে বিএনপির আন্দোলনে শরিক হতে সমস্যা নেই বলে দাবি জামায়াত নেতাদের। জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। যদিও এরশাদ একটা সময় ওই জোট থেকে বের হয়ে যান। এরপর ২০০১ সালে জোটবদ্ধ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসে। জোট সরকারের ক্ষমতার শেষ হওয়ার পর প্রায় দুই বছর ১/১১ সরকারের সময় পার করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনেও জোটগতভাবে ভোট করে বিএনপি-জামায়াত। ওই নির্বাচনে জোটটি আওয়ামী লীগের কাছে বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়।

 

জানা গেছে, ২০০৮ সালে জয়লাভ করে সরকার গঠনের পর মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি করে আওয়ামী লীগ। ওই বিচারে ইতোমধ্যে জামায়াতের জ্যেষ্ঠ ৯ নেতার বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করা হয়েছে। ২০১৩ সালের আগস্টে দেশের সর্বোচ্চ আদালত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে রায় প্রদান করেন। এরপর থেকে জামায়াত তাদের নিজস্ব প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ মার্কা নিয়ে ভোট করার ক্ষমতাও হারিয়েছে। নেতাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা ও তা কার্যকর করা এবং ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকানো ইস্যুতে জ¦ালাও-পোড়াও আন্দোলনের অভিযোগ রয়েছে দলটির বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় অসংখ্য মামলার ঘানি টানছেন দলটির নেতাকর্মীরা। ওই সময়কার আন্দোলনে বিএনপিকে খুব একটা পাশে পায়নি জামায়াত। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জামায়াত নিজেদের মাঠের রাজনীতিতে অনেকটাই গুটিয়ে নেয়। এরপর জামায়াতের তৃণমূল ব্যস্ত ‘দাওয়াতি’ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পরাজিত হওয়ার পর আরো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে জামায়াত। পরে দলটি বিভিন্ন সেক্টরে দক্ষ লোকবল সৃষ্টির মিশনে মাঠে নামে। নানা অবিশ^াস ও মান-অভিমানে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ২০ দলীয় জোটও অকার্যকর হয়ে পড়ে। বিএনপিও অনেকটাই ‘একলা চলো’ নীতিতে এগোতে থাকে। জোটসঙ্গী জামায়াতের ব্যাপারে ‘কৌশলী’ বিএনপি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে ‘বৃহৎ ঐক্য’ গড়তে তৎপর হয়।

 

এরই মাঝে গত বছরের ২৭ আগস্ট জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বিএনপি জোট ছাড়ার ঘোষণার ভিডিও ব্যাপক ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এতদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম। তবে বছরের পর বছর পর এ ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। তবে জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে তাদের যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করব আমরা’। যদিও এর কয়েকদিন পর গত ৯ ডিসেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জোটের এক সভায় রাজনৈতিক কৌশলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কার্যত ভেঙে দেয়া হয়। পরে গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠের জনসভায় ১০ দফা দাবি আদায়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ওইদিন বিকেলেই জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান বিএনপির কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বক্তব্য দেন। এরপর গণতন্ত্র মঞ্চ, ১১ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ কয়েকটি দল নিজস্বভাবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়।

 

সূত্র বলছে, প্রথম দিকে বিএনপির যুগপৎ কর্মসূচিতে মাঠে ছিল জামায়াত। পরে যুগপৎ আর কোনো কর্মসূচিতে সরাসরি অংশ নেয়নি দলটি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর্তমানে বিএনপি নিজস্ব সিদ্ধান্তে কর্মসূচি ঠিক করে শরিকদের জানিয়ে দেয়। সেখানে আপত্তি আছে জামায়াতের। এছাড়া যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নেতাদের নিয়ে বৈঠক করলেও সেখানে জামায়াতকে না রাখায় দলটির নেতাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপি অতি কৌশলী হওয়ার বিষয়টি দলটি ভালোভাবে নিতে পারেনি। সব মিলিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে দীর্ঘদিনের সঙ্গী জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয় বিএনপির। মাঝে কয়েক মাস জামায়াত বেশ পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় ছিল। জামায়াতে ইসলামী দেখতে চায় আসলে বিএনপির আন্দোলন কোনদিকে যায়। টিকে থাকার মতো পর্যায় বা সরকারকে চ্যালেঞ্জের মতো কোনো আন্দোলন করতে পারলে বা সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে অবশ্যই সেই আন্দোলনে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামতে চায় জামায়াতে। আর বিএনপি সঠিক পন্থায় আন্দোলন করতে না পরলে অতীতে; বিশেষ করে ২০১৩-১৪ সালের মতো মাঠে নেমে নতুন করে ক্ষতির শিকার হতে চান না দলটির নেতাকর্মীরা।

 

তবে বেশ কিছুদিন দূরত্বের পর দল দুটির নেতাদের মাঝে নতুন উপলব্ধি বা ভুল বোঝাবুঝির অবসান হতে চলেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। জামায়াত নেতারা সাম্প্রতিক সব সভা-সমাবেশে সরকারবিরোধী বক্তব্যও জোরালো করেছেন। আগামীতে কঠোর আন্দোলনের কথা বলছেন তারা। দল দুটির নেতারা বলছেন, তাদের চাওয়া অভিন্ন। তারা বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন চান। সে জায়গা থেকে তারা আগামী আন্দোলনে সময়মতো একসঙ্গে রাজপথে থাকবেন বলে শোনা যাচ্ছে। পর্দার আড়ালে এ দুই দলের নেতাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে বলেও জানা গেছে। তবে এক্ষেত্রে জামায়াতের দুটি বিশেষ শর্ত আছে। একটি হচ্ছে, বিএনপিকে শক্তভাবে মাঠে নামতে হবে। অন্যটি হচ্ছে যুগপৎ আন্দোলনের পদ্ধতিগত পরিবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ জামায়াত নেতারা বলছেন, কোনো কর্মসূচি দেয়ার আগে যুগপৎ দল হিসেবে জামায়াতের কাছ থেকে পরামর্শ বা আলোচনা করে কর্মসূচি গ্রহণে সিদ্ধান্ত নেয়া। এছাড়া জামায়াতকে মূল্যায়নের বিষয়টি মাথায় রয়েছে। এসব বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে বোঝাপড়া ঠিক হলে দলটি যে আবারো মাঠে নামতে চায়, তা নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট।

 

দলটির তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব মনোভাবের সত্যতাও পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিয়ে যশোর জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য এবং শিক্ষা, সহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ফজলুল হকের সঙ্গে ভোরের আকাশের এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনেও মাঠে আছে জামায়াত। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচির পাশাপাশি স্বতন্ত্র কর্মসূচিও পালন করা হচ্ছে। সাবেক এ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, নানা কারণে এখনো দলের নেতাকর্মীরা সিরিয়াসলি মাঠে নামেনি। রাজধানীর রমনা থানা জামায়াতের সেক্রেটারি আতিকুর রহমান বলেন, দলীয় অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড নিয়ে আমরা এখন ব্যস্ত রয়েছি। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে কর্মীরা মাঠে আছে ও থাকবে। আগামীতে দল সিদ্ধান্ত নিলে তারা কঠোরভাবে মাঠে থাকবেন।

 

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আজীজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, আগে কর্মসূচি পালন করা হতো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে। আর এখন হচ্ছে যৌথভাবে। ‘জোটবদ্ধ ও যৌথভাবে’ এক জিনিস নয়। জামায়াত যুগপৎ অনেক কর্মসূচি একসঙ্গে পালন করছে। আবার পৃথকভাবেও কর্মসূচি পালন করছি আমরা। তিনি বলেন, কর্মীদের মাঝে অতীতেত নানা অভিজ্ঞতা আছে। তবে বৃহৎ স্বার্থে তা সামনে আনা সমীচীন নয়। দল যখন সিদ্ধান্ত নেবে, তখন সবাই মাঠে নামবে। ভোটাধিকারের আন্দোলনে জামায়াত মাঠে ছিল আগামীতেও থাকবে। আর জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, বিএনপি বর্তমানে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সঙ্গে যুগপৎভাবে কয়েকটি দল কর্মসূচিতে মাঠে আছে। জামায়াতও শুরুতে ছিলÑ এ কথা সত্য। কিন্তু জামায়াত যখন দেখেছে যুগপৎ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মতামত নেয়ার প্রয়োজন হয়, সেখান থেকে দলটি একা চলছে।

 

তার দাবি, বিএনপির এ যুগপৎ কর্মসূচির পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। যুগপথের দল হিসেবে কর্মসূচি গ্রহণে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। অন্যথায় কারো গৃহীত সিদ্ধান্ত জামায়াত মানবেÑ এটা হতে পারে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াত ও বিএনপির চাওয়া হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন। লক্ষ্য অভিন্ন, তাই সব ঠিকঠাক বা বোঝাপড়া ঠিক হলে বিএনপির সঙ্গে থেকে আন্দোলন করতে বাধা থাকার কথা নয়। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে পর্দার অন্তরালে আলোচনার ব্যাপারে তিনি বলেন, জামায়াত কোনো গোপন বৈঠকে বিশ^াস করে না। আগে যেমন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আমাদের প্রতিনিধিরা বৈঠক করত প্রকৃত কোনো বৈঠক হলে ওইরকমভাবে সবাই দেখতে পারবে। এদিকে বিষয়টি নিয়ে কৌশলী বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললেও জামায়াত কথা বলতে নাম প্রকাশ করতে চাননি। বিএনপির একটি সূত্র বলছে, দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জামায়াতকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণা থাকায় চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে তারা দলটিকে মাঠে নামানোর বিষয়টি সামনে আনতে চাইছেন না।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version