-->
শিরোনাম

নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা থাকছে ইসির হাতেই

শাহীন রহমান
নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা থাকছে ইসির হাতেই

শাহীন রহমান : অনিয়মের অভিযোগ পেলে নির্বাচন কমিশনকে পুরো নির্বাচন নয়, আংশিক নির্বাচন স্থগিত বা বাতিলের ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনীর প্রস্তাব অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরপিওতে অনিয়মের কারণে নির্বাচন স্থগিত বা বাতিলের ক্ষমতা ইসিকে আগেই দেয়া হয়েছে। আরপিও সংশোধনীর ইসির যে প্রস্তাব তা এক ধরনের অজ্ঞতা থেকেই করা হয়েছে। এটা তাদের করার প্রয়োজন ছিল না। এ বিষয়ে আইন সংশোধনের প্রস্তাব করে ইসি নিজেদের ক্ষমতাকে ছোট করেছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের এর আগের যে ক্ষমতা ছিল সেটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। বরং তারা যে নতুন বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল, তার মধ্যে অস্পষ্টতা দেখা দিয়েছে। তবে মন্ত্রিসভা যে ক্ষমতাই দিক না কেন, বিদ্যমান আইনে পুরো নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা ইসির হাতে থাকছেই। সংবিধানেই এ ক্ষমতা ইসিকে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যাতে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে, সেটা করতে না পারলে যে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতাও কমিশনের রয়েছে। এছাড়া এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একাধিক রায়ও রয়েছে। ফলে ইসির ক্ষমতা খর্ব করে আরপিও সংশোধন হলেও পুরো নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা ইসির হাতে থাকছেই। বিশেষজ্ঞরা বরছেন, ইসির এই ক্ষমতা খর্ব করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন্ত্রিসভায় যে সিদ্ধান্তই হোক না কেন গাইবান্ধার মতো নির্বাচন চলাকালীন সময়ে সেটি বাতিল করার ক্ষমতা এখনো নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে গণপ্রতিনিধিত্ব আইনেই দেয়া আছে। আরপিও বা গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৭ম অধ্যায়ের ৯১ (ক) ধারায় বলা হয়েছে যে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন ও চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন যে কোনো ভোটকেন্দ্র বা (ক্ষেত্রমতে সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায়) নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন যে ক্ষমতা চেয়েছিল, তা দিলে কোনো সমস্যা হতো না। তবে এই আইন ছাড়াও নির্বাচন কমিশন এখনো নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা রাখে।

 

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ভোট গ্রহণের জন্য নির্বাচনী শিডিউল চলাকালীন হতে ভোট চলাকালীন পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে নির্বাচন স্থগিত, বাতিল করার বিধান আরপিওতে আগে থেকেই আছে। ৯১(ক) তে বিশেষ ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। তবে তা ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। তাই গাইবান্ধা-৫ আসনের মতো নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা ইসির এখানো অক্ষুণ্ন আছে।

 

মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনে বেসরকারি ফল ঘোষণার পরেও যদি গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তবে তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে নির্বাচন কমিশন সেই প্রশ্নবিদ্ধ কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল বা স্থগিত করতে পারবে। কিন্তু পুরো একটি আসনের ভোট বাতিল করতে পারবে না। তবে গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পর কমিশন সে বিষয়ে আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। বর্তমানেও গেজেট প্রকাশের পরে সেই সুযোগ নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনীতে এই বিধান রাখা হয়েছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন্ত্রিসভা আরপিরও সংশোধনের যে প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে, তা উচ্চ আদালতের রায়ের সঙ্গেও অসঙ্গতিপূর্ণ। স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গেজেট ঘোষণার আগে নির্বাচন বাতিল বিষয়ে যে আংশিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেটির সুবিধা-অসুবিধা নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের ওপর। উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, নির্বাচনের সময় অনিয়ম, কারচুপি হলে বা নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে নির্বাচন কমিশন সত্যতা নিরূপণ করে নির্বাচন বাতিল করতে পারবে এবং পুনরায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারবে। এখানে কোনো সেন্টার বা কেন্দ্রের বিষয়ে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। তবে যেখানে প্রয়োজন মনে করবে সেখানেই সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।

 

এছাড়া সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন আইনের বিধিবিধানও সংযোজন করতে পারে বলে উচ্চ আদালতের রায় আছে। তিনি বলেন, ইসির সব রকম ক্ষমতা আছে। মন্ত্রিসভার এই প্রস্তাব সত্ত্বেও উচ্চ আদালতের রায় আইনের সমতুল্য এবং সবার এটা মানা বাধ্যতামূলক। মন্ত্রিসভায় তারা যে প্রস্তাব করেছে, তা সঙ্গত হয়নি। কারণ তাদের এই ক্ষমতা ইতোমধ্যেই আছে। ক্ষমতা চেয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমতা খর্ব করার প্রচেষ্টা হতে পারে, ঠিক তাই হয়েছে। এখন নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবে কিনা, তাদের ক্ষমতা তারা প্রয়োগ করতে পারবে কিনা তা নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের ওপর।

 

গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভায় ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনী প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। এর আগে গত বছর এই সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। সংশোধনী প্রস্তাবে নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের একটি বিধান স্পষ্ট করার জন্য নতুন আরেকটি উপধারা যুক্ত করার প্রস্তাব করেছিল। ইসির এই সংশোধনীতে বলা হয়েছে, নির্বাচনের বেসরকারি ফল ঘোষণার পর তা গেজেট আকারে প্রকাশের আগে অনিয়ম বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ পেলে কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের নির্বাচনের ফল স্থগিত করতে পারবে। পরে এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে পুরো আসনের ভোট বাতিল করে আবারো নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।

 

তবে ইসির এই প্রস্তাবে ভ্রান্তি রয়েছে। এর আগে ইসির এই সংশোধনী প্রস্তাবের বিষয়ে গত ফেব্রুয়ারি ২৭ তারিখে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ইসি রাশেদা সুলতানা। ওই সময় তিনি বলেন, নির্বাচনের গেজেট হওয়ার পরে অনিয়ম হলে আরপিওতে কোনো কিছু করার ক্ষমতা তাদের নেই বলে তারা সেই ক্ষমতা চেয়েছিলেন। যে সংশোধনীর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তা হলো ফলাফল ঘোষণার পরেও যেন ক্ষমতাটা কমিশনের হাতে থাকে। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৯১ অনুচ্ছেদে সেই ক্ষমতা রয়েছে। তবে ওই সময় ইসির প্রস্তাবের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেছিলেন, ‘আরপিও সংশোধনের বিষয়ে অনেকেই ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, মিডিয়াতে দুটো বিষয়ে ভিন্ন রকম প্রতিবেদন এসেছে। একটি বিষয় হচ্ছেÑ যদি কোথাও গুরুতর অনিয়মের কারণে নির্বাচন স্থগিত করতে হয়, নির্বাচন কমিশন করতে পারেন, এটা আগে থেকে বলা আছে।

 

এখন (সংশোধনী প্রস্তাবে) বলা হয়েছে, কোনো একটি ফলাফল তৈরির সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা বিরবরণীটা কমিশনে পাঠাবে, তখন যদি গুরুতর কোনো অনিয়ম হয়, তখন নির্বাচন কমিশন যথাযথ তদন্ত করবে। তদন্তে ফলাফল সঠিক হলে তা প্রকাশ করবে। অন্যথায় গুরুতর অপরাধে ফলাফল সঠিকভাবে প্রতিফলিত না হলে তখন তারা বাতিল করতে পারবেন। এখানে গেজেট প্রজ্ঞাপনের পরে বাতিল করা হবে, কথাটা কিন্তু তা না।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version